ঈদুল আযহা বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন নামে পরিচিত, যেমন বাংলায় কোরবানির ঈদ বা বকরা ঈদ, আরবিতে عيد الأضحى (ʿīd al-ʾaḍḥā), তুর্কিতে Kurban Bayramı, এবং ইন্দোনেশিয়ায় Iduladha নামে পরিচিত1। এই উৎসবের ব্যুৎপত্তি আরবি শব্দ ‘ঈদ’ (উৎসব) এবং ‘আদহা’ (ত্যাগ) থেকে এসেছে।
ঈদুল আযহা, যা কুরবানির ঈদ নামেও পরিচিত, ইসলাম ধর্মের দুই প্রধান উৎসবের একটি। এই দিনটি হজরত ইব্রাহিম (আ.) এর ত্যাগ এবং আল্লাহর প্রতি তার অটল বিশ্বাসের স্মরণে পালিত হয়। ঐতিহাসিকভাবে, হজরত ইব্রাহিম (আ.) কে আল্লাহ তার প্রিয় পুত্র হজরত ইসমাঈল (আ.) কে কুরবানি করার নির্দেশ দেন, যা তিনি পালন করতে যান। কিন্তু শেষ মুহূর্তে, আল্লাহ একটি মেষ পাঠিয়ে তার পুত্রকে বদলে দেন। এই ঘটনা মুসলিমদের ঈমানের প্রতি ত্যাগ এবং আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্যের প্রতীক।
ঈদুল আযহা প্রতি বছর ইসলামি চান্দ্র পঞ্জিকার জ্বিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখে পড়ে। এই দিনে, মুসলিমরা ফজরের নামাজের পর ঈদগাহে গিয়ে দুই রাকাত ঈদের নামাজ আদায় করেন এবং তারপর তাদের আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ বা উট কুরবানি করেন। কুরবানির গোশত তিন ভাগে ভাগ করা হয়: এক ভাগ নিজের জন্য, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনের জন্য, এবং অপর ভাগ গরীব ও দুঃখীদের জন্য। এই উৎসব শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি সামাজিক সমাবেশ, দান, ভোজ এবং উপহার বিনিময়ের একটি সময়ও বটে।
ঈদুল আযহা বা কুরবানির ঈদের ইতিকথা
কুরবানির ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন এবং ইসলামের অন্যতম এক নিদর্শন। এর উৎপত্তি হযরত আদম (আ.) এর দুই পুত্রের কুরবানির মাধ্যমে শুরু হয়েছিল, যা কুরআনে বর্ণিত আছে। হযরত হাবিল এবং কাবিল উভয়েই আল্লাহর জন্য কুরবানি পেশ করেছিলেন, কিন্তু কেবল হাবিলের কুরবানিই গ্রহণ করা হয়েছিল। এই ঘটনা থেকে কুরবানির ধারণা এবং তার গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
ইসলামের অন্যতম প্রধান ঘটনা হলো হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর স্বপ্নে আল্লাহর নির্দেশে তার প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.) কে কুরবানি করার প্রস্তুতি। আল্লাহর নির্দেশে তিনি যখন তার পুত্রকে কুরবানি দেয়ার জন্য প্রস্তুত হন, তখন আল্লাহ তার পুত্রের পরিবর্তে একটি মেষ পাঠিয়ে দেন। এই ঘটনার স্মরণে প্রতি বছর ঈদ-উল-আধহা উদযাপন করা হয় এবং মুসলিমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় কুরবানি দেন।
কুরবানির শাব্দিক অর্থ হলো ‘নৈকট্য লাভ করা’ এবং এটি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করার প্রক্রিয়া। ইসলামে কুরবানি হলো নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত নিয়মে নির্দিষ্ট জন্তুকে আল্লাহর নামে জবেহ করা। এই প্রথা মুসলিম উম্মাহর জন্য সুন্নতে মুয়াক্কাদা হিসেবে গণ্য করা হয়, এবং হানাফি মাযহাবের মতে এটি ওয়াজিব।
কুরবানির দিন পশু কুরবানির চাইতে আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় আর কোন আমল নেই, এবং কুরবানির জন্তুর রক্ত জমিনে পড়ার আগেই তা আল্লাহর কাছে কবুল হয়ে যায়1। এই প্রথা মুসলিম উম্মাহর ধৈর্য, আত্মত্যাগ এবং আল্লাহর প্রতি ভক্তির প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়।
ঈদ-উল-আযহা বা কুরবানির মাসয়ালা মাশায়েল অনেক বিস্তৃত এবং গুরুত্বপূর্ণ। এখানে কিছু মৌলিক মাসয়ালা তুলে ধরা হলো:
- কুরবানীর ওয়াজিব হওয়ার শর্ত: কুরবানীর ওয়াজিব হওয়ার শর্ত সম্পর্কিত হাদীস হলো, যে ব্যক্তির কাছে নেসাব পরিমাণ সম্পদ আছে এবং সে প্রাপ্তবয়স্ক এবং সুস্থমস্তিষ্ক সম্পন্ন মুসলিম হয়, তার উপর কুরবানী ওয়াজিব। হাদীসে এসেছে, যে ব্যক্তির কুরবানীর সামর্থ্য আছে কিন্তু সে কুরবানী করে না, তাকে ঈদগাহে না আসার জন্য বলা হয়েছে। এই হাদীসটি মুস্তাদরাকে হাকেম এবং আত্তারগীব ওয়াত্তারহীবে উল্লেখিত।
কুরবানীর নেসাব হলো স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত (৭.৫) ভরি এবং রূপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) ভরি, অথবা এর মূল্যের সমপরিমাণ টাকা-পয়সা বা অন্যান্য বস্ত্তর ক্ষেত্রে নিসাব হল এর মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া। এই নেসাবের মালিক হলে এবং যিলহজ্বের ১০ তারিখের ফজর থেকে ১২ তারিখের সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সম্পদ থাকলে কুরবানী ওয়াজিব হয়।
- কুরবানীর সময়: মোট তিনদিন কুরবানী করা যায়। যিলহজ্বের ১০, ১১ ও ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত। কুরবানীর সময় সম্পর্কিত হাদীসের মধ্যে একটি প্রসিদ্ধ হাদীস হলো, নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছেন যে, ঈদের দিন প্রথমে নামাজ আদায় করা উচিত, এরপর কুরবানী করা উচিত। যে ব্যক্তি এই ক্রম অনুসরণ করে, সে সুন্নাহ অনুসরণ করে1। অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি নামাজের আগে কুরবানী করে, তা কুরবানী হিসেবে গণ্য হয় না, বরং তা তার পরিবারের জন্য মাংস প্রস্তুত করা হয়।
এই হাদীসগুলো আমাদের শিখিয়ে দেয় যে, কুরবানীর সময় নির্দিষ্ট একটি ক্রম অনুসরণ করা উচিত, যা ইসলামের শিক্ষা ও নীতি অনুযায়ী। এই হাদীসগুলো আমাদের কুরবানীর গুরুত্ব এবং এর সঠিক পদ্ধতি সম্পর্কে জানায়।
- কুরবানীর পশু: উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কুরবানী করা জায়েজ। কুরবানীর পশু সম্পর্কিত হাদীসের মধ্যে একটি হলো, নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছেন যে, কুরবানীর পশুর চোখ ও কান ভাল করে দেখে নিতে হবে এবং কান-কাটা, কান-চেরা বা কানে গোলাকার ছিদ্র করা পশু দ্বারা কুরবানী না করার নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়াও, কুরবানীর পশু যেন স্পষ্ট রোগী, খোঁড়া, অন্ধ বা অত্যন্ত দুর্বল না হয়, এমন পশু দ্বারা কুরবানী করা যাবে না।
এই হাদীসগুলো কুরবানীর পশু নির্বাচনের সময় যে সকল বিষয় বিবেচনা করা উচিত তা নির্দেশ করে।
- কুরবানীর পশুর বয়স: কুরবানীর পশুর বয়স সম্পর্কিত হাদীসের বিষয়ে, ইসলামিক শরিয়াহ অনুযায়ী কুরবানীর জন্য পশুর নির্দিষ্ট বয়স থাকা আবশ্যক। হাদীস অনুযায়ী, কুরবানীর জন্য উটের বয়স অন্তত পাঁচ বছর, গরু বা মহিষের বয়স দুই বছর, এবং ছাগল, ভেড়া বা দুম্বার বয়স এক বছর হতে হবে। তবে, ভেড়া বা দুম্বার ক্ষেত্রে যদি সংকটের অবস্থা হয়, তাহলে ছয় মাস বয়সী পশুও কুরবানীর জন্য যথেষ্ট হতে পারে।
- কুরবানীর পশুতে অংশীদারি: কুরবানীর পশুতে অংশীদারি সম্পর্কিত হাদীসের বিষয়ে, ইসলামে এটি স্পষ্ট যে একটি গরু বা মহিষের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাতজন পর্যন্ত অংশীদারি করা যায়। একটি উট, গরু, বা মহিষের কুরবানী একাধিক ব্যক্তি মিলে করতে পারেন, তবে ছাগল বা ভেড়ার ক্ষেত্রে একটি পশু একজনের জন্যই নির্ধারিত। অংশীদারির ক্ষেত্রে প্রত্যেকের নিয়ত সঠিক হতে হবে এবং সবাইকে কুরবানীর নিয়ম মেনে চলতে হবে।
ঈদুল আযহা বা কুরবানির ঈদ বিষয়ে মাসয়ালা মাশায়েল সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে এবং বুঝতে হলে, আপনি ইসলামিক শিক্ষা ও ফতোয়া সংক্রান্ত বই পড়তে পারেন অথবা আপনার স্থানীয় আলেম বা ইমামের সাথে পরামর্শ করতে পারেন।
Views: 6