ইহুদীবাদ এবং জায়নবাদের পার্থক্য হলো, ইহুদীবাদ একটি ধর্মবিশ্বাস, আর জায়নবাদ হলো কতিপয় ইহুদীদের মাধ্যমে পরিচালিত একটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন যার সাথে ইহুদীবাদের সম্পর্ক খুবই সুক্ষ্ণ।
জেরুসালিমের যে টিলায় ইসরাঈল বংশীয় বাদশা ও নবী হযরত দাউদ (আ:) এর কবর অবস্থিত, সেটিকে জায়ন পর্বত جبل صهيون বলা হয়। ইহুদীদের ফিলিস্তীনে ফেরার আন্দোলনকে এই টিলার দিকে সম্পৃক্ত জায়োনিজম বলা হয়।
ইসলাম, খ্রিষ্টান এবং ইহুদীবাদ এই তিনটি ধর্মকে আব্রাহামিক ধর্ম হিসেবে পরিচিত করা হয়ে থাকে। কারণ, এই তিনটি ধর্ম আব্রাহাম তথা ইব্রাহীম (আঃ) এর সন্তানদের হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই তিনটি ধর্মের আগে ছিল মিল্লাতে ইব্রাহীম (আ:), যা ইব্রাহীম (আ:) এর সন্তান ইসমাঈল (আ:) এর মাধ্যমে মক্কা ও তার আশপাশে প্রসারিত হয়েছিল। মক্কার গোত্রপতি আমর লুহাইর মাধ্যমে এক পর্যায়ে তাদের মাঝে মূর্তিপূজার প্রচলন ঘটে। তিনি সিরিয়া থেকে মূর্তিপূজার এই শিরক আমদানি করেছিলেন, যা থেকে আরব জাতিসহ সারা বিশ্ববাসীকে মুক্তি দিতে মহান আল্লাহ তাঁর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পাঠিয়েছিলেন।
ইব্রাহীম (আ:) এর জন্ম ইরাকে হলেও তিনি মহান আল্লাহর নির্দেশে তার দুই স্ত্রীর প্রথমজনেক ফিলিস্তীনের হেবরনে এবং দ্বিতীয়জনকে পবিত্র মক্কায় সেটেল্ড করেন। কোরআনী তথ্যমতে, উনার বৃদ্ধা প্রথম স্ত্রী সারার ঘরে অলৌকিকভাবে জন্ম নেন হযরত ইসহাক (আ:)। আর ইসহাক (আ:) এর ঘরে জন্ম নেন ইয়াকুব (আ:), যিনি ইসরাঈল নামেও প্রসিদ্ধ ছিলেন।
ইহুদীদের আদি ধর্মগ্রন্থের নাম তাওরাত, যেটাকে ইংরেজিতে ওল্ড টেস্টামেন্ট বলা হয়ে থাকে। তাওরাত নাজিল হয়েছিল মুসা (আঃ) এর উপর। তাওরাতকে ইহুদীদের আইনগ্রন্থ হিসেবে ধরা হয়, যেখানে তাদের জীবনযাপন করার সকল নির্দেশনা বিস্তারিত দেয়া ছিল । তবে পরবর্তীতে ইহুদী রিব্বীরা এতে অনেক বিকৃতি এনেছে বলে কোরআন মজীদে উল্লেখ আছে।
বনী ইসরাঈলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুজন নবী হলেন মূসা (আ:) ও ঈসা (আ:)। জেরুসালিমে জন্মগ্রহণকারী নবী ঈসা (আ:) এর উপর নাজিল হয়েছিল ইঞ্জিল, যাকে ইংরেজিতে নিউ টেস্টামেন্ট বলা হয়ে থাকে। ঈসা (আ:) বনী ইসরাঈলের নবী হওয়া সত্ত্বেও তাদের একটি বিশাল অংশ তাঁকে প্রত্যাখান করে এবং তাঁর বিরুদ্ধ ষড়যন্ত্র করে।
ওই সময় জেরুসালিম শাসন করতো রোমানরা। ঈসা (আ:) এর প্রতি যেসব লোক ঈমান এনেছিল তাদের মধ্যে ইহুদীদের চেয়ে রোমানেদর সংখ্যা বেশি ছিল। পরবর্তীতে এসব ঈমানদার রোমানদের মাধ্যমেই পার্শ্ববতী অঞ্চলসমূহ ও ইউরোপে খ্রিষ্টান ধর্ম প্রসারিত হয়।
ইহুদী ধর্মের অনুসারীরা মূলত বনী ইসরাঈল। তবে তাদের বাইরে পূর্ব ইউরোপ ও পূর্ব আফ্রিকার কিছু লোকও ইহুদীবাদে দীক্ষিত হয়েছে।
ইব্রাহীম (আ:) এর দ্বিতীয় স্ত্রী হাজেরার পুত্র মক্কায় বসবাসকারী হযরত ইসমাঈল (আ:) এর বংশে শেষনবী ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ (স:) এর আগমনের পর মহান আল্লাহ ইহুদী, খ্রিষ্টান ও আরব উপদ্বীপের মিল্লাতে ইব্রাহিমীর অনুসারীসহ পৃথিবীর সকল মানুষকে ইসলাম গ্রহণের নির্দশ দেন এবং তাদের ধর্মের যেসব রীতি-নীতি মুহাম্মদ (স:) এর আনীত রীতি-নীতির সাথে সাঙ্ঘর্ষিক সেগুলো পরিত্যাগ করতে বলেন। ফলে আরবদের অধিকাংশই, খ্রিষ্টানদের অনেকেই এবং সেই সাথে কিছু ইহুদীও ইসলাম গ্রহণ করে।
কোরআন মজীদে ইহুদীদেরকে বনী ইসরাঈল (ইসরাঈলের সন্তানবর্গ) নামে অভিহিত করা হয়েছে। ইসরাঈল ও ইয়াকুব (আ.) একই ব্যক্তি। উনার দুই স্ত্রীর মধ্যে প্রথমজনের গর্ভে দশ সন্তান জন্ম নিয়েছিল, যাদের প্রথমজনের নাম ছিল ইহুদা। এই ইহুদার দিকে সম্পৃক্ত করেই বনী ইসরাঈলকে ইহুদী বলা হয়। উনার দ্বিতয় স্ত্রীর গর্ভে জন্ম নিয়েছিল দুই সন্তান। তারা হলেন যথাক্রমে নবী ইউসুফ (আ:) ও বিনিয়ামীন।
ইউসুফ (আ:) এর মিসরের রাজত্বকালীন সময়ে ইহুদীরা ফিলিস্তীন থেকে মিসরে গিয়ে সেটেল্ড হয়েছিল। পরবর্তীতে তারা ফেরাউনের অত্যাচারের শিকার হয় এবং নবী মূসা (আ:) এর মাধ্যমে তার জুলুম থেকে মুক্তি লাভ করে। এরপর ইহুদীরা অনেক বড় ঘাড়ত্যাড়া ও দুষ্ট প্রকৃতির জাতিতে পরিণত হয়, যার বিবরণ সূরা বাকারাসহ কোরআনের বিভিন্ন সূরায় মহান আল্লাহ বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে উল্লেখ করে জানিয়েছেন।
জায়নবাদ
তাওরাতে উল্লখিত শেষনবী বিষয়ক ভবিষ্যদ্বাণী দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইহুদীরা হযরত মুহাম্মদ (স.) এর আগমনের অনেকবছর আগে ফিলিস্তীন ছেড়ে আরব উপদ্বীপের ইয়াসরিব (পরবর্তীতে মদীনা) নামক পল্লীতে সেটেল্ড হয়। কিন্তু শেষনবী হযরত মুহাম্মদ (স.) যখন সত্যি এলেন এবং মদীনায় হিজরত করলেন, তখন ইহুদী নেতারা হিংসাবশত উনাকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়।
শেষনবীর প্রতি মদীনবাসী আরবদের আগ্রহ ও উদ্দীপনা দেখে ইহুদীরা মৌখিকভাবে চুক্তি ও শান্তিতে বসবাসের কথা বললেও ভিতরে ভিতরে ষড়যন্ত্র করতে থাকে। তাদের হিংসাত্মক ষড়যন্ত্রে মদীনাকে মুসলমানমুক্ত করার উদ্দেশ্যে পঞ্চম হিজরীতে সঙ্ঘটিত হয়েছিল জঙ্গে আহযাব বা আরব-ইহুদী সম্মিলিত যুদ্ধ। কিন্তু মহান আল্লাহর ইচ্ছায় সম্মিলিত বাহিনী পরাজিত হয়।
এ ঘটনার পর মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স:) চুক্তি ভঙ্গকারী ইহুদী গোত্রগুলোকে মদীনা থেকে বিতাড়িত করেন। তখন তারা মদীনা থেকে ১৫৩ কিলোমিটার উত্তরে খাইবারের দিকে চলে যায়, যেখানে আগে থেকেই কিছু ইয়াহুদী গোত্র বসবাস করতো। দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর (র.) এর আমলে ইহুদীদেরকে খায়বার থেকে বিতাড়িত করা হলে তারা সিরিয়ায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। অতঃপর তাদের অনেক গোত্র মিসর, উত্তর আফ্রিকা, স্পেন ও পূর্ব ইউরোপেও ছড়িয়ে পড়ে।
১৮ শতকের দিকে দেখা যায়, ইহুদীরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বেশি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, বিশেষ করে রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, জার্মানী, সুইজারল্যান্ড। সেখানে ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের সাথে ইহুদীদের দ্বন্দ্ব লাগে এবং রাশিয়ায় অর্থোডক্স খ্রিষ্টানদের সাথে ইহুদীদের সংঘাত শুরু হয়। তখন থেকেই অনেক ইহুদী বুদ্ধিজীবি তাদের পূর্বপুরুষদের স্থানে একটি ইহুদী রাষ্টের কল্পনা করেন। এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যেই আন্দোলন সেটাকেই জায়নাবাদী আন্দোলন বলা হয়।
জায়নবাদের উত্থান
ইহুদীরা যখন ফিলিস্তীনে আসতে শুরু করে, তখন সেটি ছিল উসমানী সাম্রাজ্যের অধীনে। ১৮ এবং ১৯ শতকে ইহুদীদের মধ্যে হাসকালা Haskala নামক একটি বুদ্ধিভিত্তিক আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ও সংস্কৃতির সাথে ইহুদী ধর্মীয় শিক্ষার একটা মেলবন্ধন সৃষ্টি করা। এই আন্দোলনের কেন্দ্র ছিলো বার্লিন (জার্মানী)। তৎকালীন সময়ে ইহুদীদের অধিকাংশই ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বিচরণ করতো। সেই সময়েই তারা মনে করে যে তাদের এখন একসাথে থাকা উচিত এবং নিজেদের একটা সংস্কৃতি তৈরী করে একটি জনপদ সৃষ্টি করা প্রয়োজন।
এই চিন্তারই একটি রাজনৈতিক ধারণা দেন অস্ট্রিয়ান সাংবাদিক থিওডর হেজেল। তিনি ইহুদীদের উপর বৈষ্যমের কথা তুলে ধরে ইহুদী রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। পরবর্তীতে ১৮৯৭ সালে সুইজারল্যান্ড প্রথম জায়োনিস্ট কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে নেতারা বলেন, “জায়োনিজম এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ইহুদিদের জন্য ফিলিস্তীনে একটা নিরাপদ আবাস নির্মাণ করা যেটি আইন দ্বারা সুরক্ষিত থাকবে।”
এভাবে প্রতি দুই বছর অন্তর জায়োনিস্ট কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হওয়া শুরু করে। তখন তারা ফিলিস্তীনে আইনগতভাবে সেটেল্ট হতে চাইলে সেটা উসমানী শাসকরা নাকচ করে দেন। এরপর তারা ব্রিটিশদের কাছে যায়। ব্রিটিশরা সেটেলমেন্টের জন্য বর্তমান আফ্রিকার উগান্ডাকে প্রস্তাব করে, কিন্তু তারা ফিলিস্তীনের জন্যই গো ধরে বসে থাকে। এটা ১৯০২-০৪ সময়ের কথা। এরপর প্রেক্ষাপট দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে।
জায়নবাদীরা ইহুদীদের সামান্য অংশের প্রতিনিধিত্ব করতো। তাদের বেশির ভাগই ছিলো রাশিয়ান ইহুদী। তবে আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলো অস্ট্রিয়ান ও জার্মান ইহুদী। এই জায়নবাদীরা সুসংগঠিত ছিলো। তাদের নিজস্ব পত্রিকা ছিলো, তারা নিজেদের কার্যক্রমকে ইহুদী রেনেসাঁ বলে প্রচারণা শুরু করে।
১৯০৫ সালে রাশিয়ার বিপ্লবের পর অনেক ইহুদী দেশ ছেড়ে ফিলিস্তীনের দিকে চলে আসে। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ১৯১৭ সালে জায়োনিস্ট আন্দোলন রাশিয়ান ইহুদীদের হাতে চলে যায়। ইংল্যান্ডে অবস্থাকারী দুই জায়োনিস্ট নেতা চেইম ওয়াইজম্যান এবং ন্যাহুম সকোলোর প্রচেষ্টার ফলে তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বেলফোর ১৯১৭ সালের ২রা নভেম্বর ইহুদীদেরকে লেখা এক পত্রে ফিলিস্তিনী ভূখন্ডে একটি ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন। সেটি পরে ১৯২২ সালে তৎকালীন জাতিসংঘের (লিগ অব নএশনএর) ম্যাণ্ডেটের অন্তর্ভুক্ত হয়। এরপর ফিলিস্তীনে ইহুদী স্যাটেলারদের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। ১৯২৫ সালে ফিলিস্তীনে ইহুদীর সংখ্যা ছিল যেখানে ১০ লাখ, সেটি ১৯৩৩ সালে গিয়ে দাঁড়ায় ২৩ লাখে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কেন্দ্রীয় শক্তি পরাজিত হবার পর ১৯১৯ সালে ফ্রান্স সিরিয়া ও লেবানন দখল করে নেয়। ১৯২০ সালে ব্রিটিশরা দখল করে নেয় ফিলিস্তীন ও পূব জর্দান। বিশ্বযুদ্ধে উসমানী সাম্রাজ্য অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, জার্মানি ও বুলগেরিয়ার সঙ্গে কেন্দ্রীয় জোটে যোগ দিয়েছিল। যুদ্ধকালীন সময়ে ১৯১৬ সালে ব্রিটিশ সরকার জাতিয়তাবাদী মন্ত্রে উজ্জীবিত করে আরবদেরকে উসমানীদের বিদ্রোহে উস্কে দেয় এবং তাদেরকে উসমানী সাম্রাজ্য থেকে আলাদা করে ফেলে।
এই অবস্থায় উসমানী সাম্রাজ্য সমর্থক সিরিয়ান আলিম ইজ্জুদ্দীন আল-কাসাসম (১৮৮২-১৯৩৫) মুসলিম যুবকদেরকে নিয়ে ফরাসী দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে গড়ে তুলেন। দামেস্ক ও আলেপ্পোতে তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। সেখানে খুব একটা সুবিধা করতে না পারায় পরে (১৯২০) তিনি ফিলিস্তীনের হাইফা শহরে চলে যান এবং সেখানে ইসলামী শিক্ষার প্রচার-প্রসারে আত্মনিয়োগ করে লোকজনকে ইহুদী সেটেলারদের বিরুদ্ধ সংগঠিত করতে থাকেন। তিনি ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ শাসন এবং জায়নবাদীদের আধিপত্য উৎখাতের জন্য নৈতিক, রাজনৈতিক ও সশস্ত্র সংগ্রাম অপরিহার্য মনে করতেন। তিনি সেখানে আল-কাফ আল-আসওয়াদ (কালো হাত) নামে একটি গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলেন এবং ইহুদী সেটেলারদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করেন। ১৯৩৫ সালের ৮ নভেম্বর শেখ জায়েদ পল্লীর একটি গুহায় ব্রিটিশ দখলদারদের পুলিশ আল-কাসসামকে ঘিরে ফেলে। ঘেরাও হওয়ার পর তিনি তার লোকদের শহীদের মত মৃত্যুবরণের আহবান করে গুলি বর্ষণ শুরু করেন এবং এক পর্যায়ে শাহাদত বরণ করেন। ফিলিস্তীনের সশস্ত্র আন্দোলন হামাসের সামরিক শাখার নাম রাখা হয়েছে ইজ্জুদ্দিন আল-কাসসাম ব্রিগেড এবং তারা নিজেদের প্রস্তুতকৃত ও ব্যবহৃত স্বল্পপাল্লার রকেটের নামও আল-কাসসাম রেখেছে।
এরপর জার্মানিতে হিটলারের উত্থান হয় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে তার সৈন্যরা ইহুদীদের উপর গণহত্যা চালায়। এর ফলে বিশ্ববাসীর কাছে ইহুদীদের প্রতি একটি সহমর্মিতার জায়গা তৈরী হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইহুদীরা দলে দলে ফিলিস্তীনে এসে আবাস গড়তে শুরু করে।
১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এক প্রস্তাবে ফিলিস্তীনকে দুইভাগে বিভক্ত করার কথা বলা হয়। এতে পক্ষে ভোট পড়ে ৩৩টি, বিপক্ষে ১৩টি। দশটি দেশ ভোটদান থেকে বিরত থাকে।
প্রস্তাব অনুযায়ী ফিলস্তীনের ৫৭.৭% জায়গা নিয়ে গঠিত হবে ইসরাঈল। বাকী ৪২.৩% জায়গা পাবে আরবরা। আর আরবদের জায়গাতে থাকা গুরুত্বপূর্ণ জেরুসালিম ও বেথেলেহাম শহর থাকবে জাতিসংঘের অধীনে।
তাছাড়া ওই প্রস্তাবে ইসরাঈলের সীমানা এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়, যাতে ভবিষ্যতে ইসরাঈলের পক্ষে বাকী ৪২.৩% দখলে নেওয়া সহজে সম্ভব হয়। ইসরাঈল জাতিসংঘের এমন প্রস্তাবে সমর্থন জানায় এবং মিসর ও সৌদি আরবসহ মুসলিম দেশগুলো তার বিরোধিতা করে।
১৪ মে ১৯৪৮ সালের ইঙ্গ-মার্কিন শক্তির সমর্থন নিয়ে ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ঘোষণা করা হয়। এরপরের দিন ১৫ মে ১৯৪৮ মিসর, জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া এবং ইরাক বাহিনী ইসরায়েল আক্রমণ করে। এতে ইঙ্গ-মার্কিন শক্তির সমর্থন পাওয়া ইসরাঈলীরা বিভক্ত আরবদের উপর জিতে যায়। এই যুদ্ধের ফলে সাত লাখ আরব তাদের বাড়িঘর ত্যাগ করে শরণার্থী হয়ে পড়ে।
এরপর ১৯৬৭ সালের জুন মাসে ইসরাঈল মিসর ও সিরিয়ায় হামলা করে এবং আরবদের জন্য জাতিসংঘের বরাদ্দকৃত ফিলিস্তীনের বাকী ৪২.৩% অংশও (জর্দানের অধীনে থাকা পশ্চিমতীর ও মিসরের অধীনে থাকা গাজা) দখল করে নেয়। সেই সাথে মিসরের বিশাল সিনাই উপত্যকা ও সিরিয়ার গোলান মালভূমির দুই তৃতীয়াংশও দখল করে নেয়। ১৫ বছর পরে (১৯৮২ সালে) আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় অনেক শর্ত সাপেক্ষে ইসরাঈল সিনাই উত্যকা ফেরত দিলেও গোলান মালভূমি আর ফেরত দেয়নি।
পশ্চিমা বিশ্ব ও তাদের মিত্রদেশগুলোর নিয়ন্ত্রণাধীন জাতিসংঘের পক্ষ থেকে গৃহীত বিভিন্ন প্রস্তাবে ইসরাঈলকে ১৯৬৭ সালে দখল করা আরবভূমি ছেড়ে দিতে বলা হলেও ইসরাঈল এসব প্রস্তাবকে সবসময় বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আসছে। বরং সরকারী অফিস ও সেটেলম্যানদের জন্য আবাস নির্মাণের প্রয়োজনে দিনদিন ফিলিস্তিনীদের ঘরবাড়ি ও পাড়া-গ্রাম নানা অজুহাতে দখল করে নিচ্ছে। সেই সাথে ইহুদীদেরকে মসজিদে আকসায় প্রবেশের সুযোগ করে দিচ্ছে এবং প্রতিবাদকারী মুসলমানদের উপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে।
আরব দেশগুলোর মাঝখানে তাদের জায়গা-জমি জবরদখলের মাধ্যমে ভয়ঙ্কর একটি জায়নাবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার অর্থ হলো মুসলমানদের ঐক্য ও আত্মমর্যাবোধে ভয়ঙ্কর ফাটল ও অসহনীয় দুর্বলতা রয়েছে।
মূল লেখা : আবুল হুসাইন আলেগাজী
ইসলামী গবেষক ও সমাজ চিন্তক।
Views: 0