৬২৪ সালের এইদিনে (১৩ মার্চ), ২য় হিজরী সনের ১৭ রমজান বদর যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হয়েছিল। এইদিন আমর ইবনে হিশাম (আমরা যাকে আবু জাহেল নামে চিনি) এর নেতৃত্বে এগিয়ে আসা কুরাইশ বাহিনীর প্রতিরোধে সাইয়্যিদুনা মুহাম্মদ (সাঃ) সাহাবাগণকে (রাঃ) নিয়ে গঠিত বাহিনীর নেতৃত্ব প্রদান করেন। এটা ছিল মুসলিমদের প্রথম প্রত্যাক্ষ যুদ্ধ, যা বিশ্ব ইতিহাসের গতিপথ বদলে দেয় চিরদিনের জন্য।
৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় হিজরতের পর মদিনার মুসলিম ও অমুসলিম জনগণ মুহাম্মদ (সাঃ)কে নেতা গ্রহণ করেছিল। এটা মক্কাবাসীরা মেনে নিতে পারেনি। তারা মুসলিমদের উপর নিপীড়ন এবং তাঁদের জমি ও সম্পদ দখল করতে থাকে। মুসলিমদের দুনিয়া থেকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার অভিপ্রায়ে ৬২৪ সালের শুরুতে মক্কার আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে একটি কাফেলা সিরিয়া থেকে যুদ্ধ সামগ্রী নিয়ে ফিরছিল।
ঐ কাফেলাকে প্রতিহত করতে রাসূল (সাঃ) ৩০০ জনের একটি দল গঠন করেন। বিষয়টি আবু সুফিয়ান জানতে পারেন। তিনি দমদম বিন আমরকে মক্কায় পাঠান। দমদম নিজ উটের নাক-কান কেটে, জিন উল্টে দিয়ে, নিজ জামা ছিঁড়ে বলতে থাকে “হে কুরাইশরা! আবু সুফিয়ানের কাফেলা মুহাম্মদ (সাঃ) ও তাঁর সঙ্গীদের দ্বারা আক্রান্ত!” ওদিকে আবু সুফিয়ান পথ পরিবর্তন করে ভিন্নপথে মক্কায় চলে গেছেন।
মক্কাবাসীরা দ্রুত প্রচুর উটসহ ১৩০০ লোকনিয়ে একটি এক্সসটেড বাহিনী গঠন করে ফেলে। তারা বদরের দিকে অগ্রসর হয়ে আল-জুহফা উপত্যকা অতিক্রম করে। এখানে তারা আবু সুফিয়ানের নিরাপদে মক্কায় পৌছানোর খবর পায়। তখন অধিকাংশ লোক মক্কায় ফেরার ইচ্ছা প্রকাশ করে। কিন্তু বীরত্ব প্রদর্শনের এমন সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করতে আবু জাহল আগ্রহী ছিল না। সে বদরে যাওয়ার জন্য অনড় রইল।
আবু জাহেল সেখানে একটি বিশাল ভোজের আয়োজন করল। এতে সে মুসলিমদের ও আশেপাশের গোত্রগুলিকে দেখাল যে, তারা শ্রেষ্ঠ। তথাপি বনু জাহরাহ গোত্রপতি ইবনে শুরাইক প্রায় ৩০০ লোক নিয়ে মক্কায় ফিরে যায়। আবু জাহল, ইবনে উৎবা, উৎবা ইবনে রাবিয়া ও উমাইয়া ইবনে খালাফ-সহ মক্কার উল্লেখযোগ্য সকল অভিজাত মক্কার বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। ফলে, অন্যরা চাইলেও ফেরত যেতে পারল না।
মুহাম্মদ (সাঃ) ৩১৩ জনের একটি মামুলী বাহিনী সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। এরমধ্যে ৮২ জন মুহাজির, আওস গোত্রর ৬১ জন ও খাযরাজ গোত্রের ১৭০ জন। পুরো বাহিনীতে মাত্র দুটি ঘোড়া (জুবায়ের ইবনুল আওয়াম ও মিকদাদ ইবনে আমরের) এবং ৭০টি উট ছিল। মুহাম্মদ (সাঃ) বাহিনী নিয়ে উত্তর দিকে অগ্রসর হন। তিনি বাসবাস আল-জুহানি ও ‘আদি আল-জুহানি’কে স্কাউট করার জন্য প্রেরণ করেন।
কুরাইশরা বদর প্রান্তরে দক্ষিণ-পূর্ব অংশে তাঁবু স্থাপন করে। মুসলিম বাহিনী উত্তরে অংশে খেজুর বাগানে অবস্থান গ্রহণ করে। তাঁরা একটি পানির কূপ আয়ত্বে নেন এবং মক্কাবাসীদের পানি সরবরাহ লাইন বন্ধ করে দেন। ১১ মার্চ (১৫ রমজান) রাতে প্রবল বৃষ্টিপাত হয়। বাগানের মধ্যে মুসলিমরা নিরাপদে থাকলেও কাফেররা নাস্তানাবুদ হয়ে যায়। তাদের অবস্থান ঢালে হওয়ায় আরোহণের চেষ্টা করতে গিয়ে কষ্ট ভোগ করে।
মুহাম্মদ (সাঃ) একটি সভা আহ্বান করেন। এখানে প্রথমে আবু বকর (রাঃ) ও উমর (রাঃ) বক্তব্য দেন। তারপর মিকদাদ ইবনে আমর বলেন: “ ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ)! আল্লাহ আপনাকে যা নির্দেশ দেন, সেখানেই এগিয়ে যান। আমরা আপনার সাথে আছি। আমরা সেভাবে বলব না যেভাবে বনী ইসরাঈলরা মূসা (আঃ)কে বলেছিল: “তুমি ও তোমার প্রতিপালক যাও, যুদ্ধ করো এবং আমরা এখানেই থাকব”।
মুহাম্মাদ (সাঃ) আনন্দিত হন এবং তাঁদের জন্য দোয়া করেন। কিন্তু যে তিনজন কথা বলেছেন তারা সকলেই ছিলেন মুহাজির, যারা বাহিনীর মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। নবী (সাঃ)কে চিন্তিত দেখা গেল। আকাবার শপথে আনসারগণ মদীনার বাইরে যুদ্ধ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন না। তিনি (সাঃ) পরোক্ষভাবে আনসারদের মতামত চাইলেন। এটা সাদ ইবনে মুয়াদ (রাঃ) বুঝতে পারেন এবং অনুমতি নিয়ে বলতে শুরু করেন-
“হে আল্লাহর নবী! আমরা আপনার প্রতি ঈমান এনেছি, আপনি যা নিয়ে এসেছেন আমরা তার সত্যতা সাক্ষ্য দিচ্ছি। আমরা আপনাকে আমাদের ত্যাগ ও আনুগত্যের দৃঢ় অঙ্গীকার দিচ্ছি। আপনি আমাদেরকে যা আদেশ করবেন, আমরা আপনার প্রতি স্বেচ্ছা আনুগত্য করব। আল্লাহর কসম, যিনি আপনাকে সত্যের সাথে পাঠিয়েছেন, যদি আপনি আমাদেরকে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলেন, আমরা খুব সহজেই তা করব, আমাদের একজনও পিছিয়ে থাকবে না। শত্রুর মোকাবিলা করতে আমরা অস্বীকার করি না। আমরা আশা করি- আল্লাহ আপনাকে আমাদের হাতে এমন বীরত্বের কাজ দেখাবেন যা আপনার চোখকে তৃপ্ত করবে। দয়া করে আল্লাহর নামে আমাদের যুদ্ধে নিয়ে যান”।
মুসলিম বাহিনীর কমান্ডার নিযুক্ত হন মুসআব ইবনে উমাইর; ৮২ জন মুহাজিরের নেতৃত্বে নিযুক্ত হন আলী (রাঃ); আর ২৩১ জন আনসারীর পতাকা বহন করেন সা’দ ইবনে মুআয। উল্লেখ্য, মদীনার লোকেরা যুদ্ধে অভ্যস্ত ছিল না। যাহোক, ঘোড়ার অধিকারী জুবায়ের (রাঃ) রাইট উইং কমান্ড করেন, আর মিকদাদ লেফট উইং দিকের কমান্ড করেন। ফ্ল্যাংক উইং এর নেতৃত্বে ছিলেন কায়েস ইবনে আবি সাসাআহ।
আলী, জুবায়ের ও সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ)কে রেকি করতে পাঠানো হয়। তাঁরা মক্কার দুই পানিবাহীকে বন্দী করে নিয়ে আসে। মুহাম্মদ (সাঃ) তাদের নিকট থেকে মক্কা বাহিনীর বিবরণ জেনে নেন। ১২ মার্চ তিনি (সাঃ) বদরে উপস্থিত হন। তিনি মুসলিম বাহিনীকে যে কোনো পরিস্থিতিতে তাঁর অনুমতি ছাড়া আক্রমণ শুরু না করা এবং রাতে ঘুমানোর নির্দেশ দিয়ে নিজে পুরো রাত সালাত আদায় করে কাটান।
১৩ মার্চ (১৭ রমজান) কুরাইশরা বদর উপত্যকায় প্রবেশ করে। যুদ্ধের শুরুতে মক্কার আসওয়াদ বিন আব্দুল-আসাদ মাখজুমি মুসলিম বাহিনীকে মল্লযুদ্ধের চ্যালেঞ্জ করেন। জবাবে নবী (সাঃ) এর চাচা হামজা ইবনে আবদুল-মুত্তালিব এগিয়ে যান। হামজার (রাঃ) প্রথম আঘাতেই আসওয়াদ ভূপাতিত হন এবং পরবর্তী আঘাতে তার মস্তক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মুসলিমরা আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে প্রান্তর মুখরিত করে তোলেন।
বীর আসওয়াদের পরিণতি দেখে ঢাল ও বর্মে সুরক্ষিত উতবা বিন রাবিয়া, তার ভাই শাইবা বিন রাবিয়া ও পুত্র ওয়ালিদ মল্লযুদ্ধে আবির্ভূত হন। বিপরীতে তিন জন আনসার আউফ ইবনে হারিস, মুয়াবিজ ইবনে হারিস ও আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা এগিয়ে এলেন। “কুরাইশরাই আমাদের সাথে যুদ্ধ করার উপযুক্ত”- বলে মক্কাবাসীরা দাবী করে। তখন হামজা (রাঃ) উবায়দা ইবনে হারিস ও আলী (রাঃ)কে ডেকে নেন।
হামজা (রাঃ) এবারও দুই আঘাতে শাইবাকে হত্যা করতে সক্ষম হন। পাশে বালক আলী (রাঃ) ৩ আঘাতে পালোয়ান ওয়ালিদকে হত্যা বিরুদ্ধে করেন। অপরদিকে, উবায়দা (রাঃ) এর তরবারির আকার ছোট হওয়ায় তা চালাতে গিয়ে নিজের আঘাতে নিজেই আহত হন, তবে তিনি উতবাকে হত্যা করতে সক্ষম হন। তিনি ঐ আঘাতে পরবর্তীতে শহীদ হয়েছিলেন। কুরাইশরা আর মল্লযুদ্ধের সাহস করল না, সরাসরি আক্রমণ করল।
কুরাইশরা অগ্রসর হলে মুসলিমরা তীর চালান। তারা নিকটবর্তী হলে মুসলিমরা ঝাঁপিয়ে পড়েন। এতে অল্পক্ষণেই কুরাইশরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পিছু হটতে শুরু করে। মুয়াজ ইবনে আমর (রাঃ) ও মুয়াজ ইবনে আফরা (রাঃ) কুরাইশ সর্বাধিনায়ক আবু জাহলকে হত্যা করেন। বিলাল (রাঃ) তাঁর সাবেক মনিব উমাইয়া ইবনে খালাফকে হত্যা করেন। উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) নিজ মামা আস ইবনে হিশাম ইবনে মুগিরাকে হত্যা করেন।
বিকেলের মধ্যে যুদ্ধ শেষ হয়। যুদ্ধে ৭০ জন কুরাইশ নিহত ও অপর ৭০ জন বন্দী হয়। মুসলিমরা নিজেরা পায়ে হেটে বন্দিদেরকে উটে চড়িয়ে নিয়েছিল। বন্দিরা এটা টিটকিরি মনে করলেও যখন দেখল যে, বিজয়ীরা খেজুর খেয়ে বন্দিদের গমের রুটি দিচ্ছে- এতে তাদের ভুল ভেঙ্গে যায়। পরে সামর্থবান বন্দিদেরকে মুক্তিপণের বিনিময়ে এবং শিক্ষিত বন্দীদেরকে প্রত্যেকে দশজন করে মুসলিমকে লেখাপড়া শেখানোর বিনিময়ে মুক্তিলাভ করেন। এই বন্দীদের অধিকাংশ ইসলাম গ্রহণ করেন।
একটা ব্যাপার খেয়াল করুন- মুসলিম সৈন্য সংখ্যা ছিল ৩১৩, তাঁদের বাহন ছিল ৭০টি উট ও ২টি ঘোড়া। ফলে, তাঁরা একটি উটে পালাক্রমে ২ বা ৩ জন আরোহণ করতেন এবং অপর ২ বা ৩ জন হাঁটতেন। মুহাম্মাদ (সাঃ) নিজে আলি (রাঃ) ও মারসাদ (রা) এর সাথে উট ভাগাভাগি করে পথ পাড়ি দেন। অথচ তিনি সামান্যতম ইঙ্গিত করলেও ২টি ঘোড়া তাঁর একার জন্য বরাদ্দ করে সাহাবাগণ (রাঃ) নিজেদের ধন্য মনে করতেন।
Views: 0