১. পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ভিত্তি যে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের লাহোর প্রস্তাব, তা উত্থাপন করেছিলেন শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক, একজন বাঙালি রাজনীতিবিদ। তিনি সর্বপ্রথম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহ নিয়ে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করেছিলেন, যার ভিত্তিতে মুসলিম লীগ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু করে।
১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতিতে ভারতের মুসলমানদের জন্য পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের প্রস্তাব রেখেছিলেন।
সুতরাং পাকিস্তানের মূল প্রতিষ্ঠাতা যদি কেউ হয়ে থাকেন তিনি অবশ্যই শেরে বাংলা একে ফজলুল হক। তাঁর লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন ব্যতীত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা ছিলো অসম্ভব।
২. মুসলিম লীগের শক্তিশালী ঘাঁটি ছিলো বাংলা প্রদেশ। অন্যান্য প্রদেশের সরকার প্রধান কে মুখ্যমন্ত্রী বলা হলেও বাংলা প্রদেশের সরকার প্রধান কে ‘প্রধানমন্ত্রী’ বলা হতো ।
পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বেই বাংলা পেয়েছিলো তিন তিনজন মুসলিম প্রধানমন্ত্রী — শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, নবাব খাজা নাজিমউদ্দিন এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। বাংলার তিনজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর তিনজনই ছিলেন মুসলিম। যা মুসলিম জনগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষায় বাঙালি মুসলিমের অবদানকে নির্দেশ করে।
৩. সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ঢাকায় ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে।
৪. ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে বাংলা প্রদেশে মুসলিম লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা চূড়ান্ত করে দিয়েছিলো।
৫. শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী ও অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃবৃন্দ বাংলা ভাগের হীন চক্রান্তে লিপ্ত হলে বাঙালি মুসলিমের মহান নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম এর বিরোধিতা করেন। তাঁদের সাথে যুক্ত হন কংগ্রেস নেতা কিরণ শংকর রায় ও শরৎ চন্দ্র বসু।
বাংলার অখণ্ডতা রক্ষার জন্য সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসু ‘স্বাধীন অখণ্ড বাংলা’র প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তাঁরা প্রস্তাব রাখেন – ‘বাংলা পাকিস্তানের সাথেও যাবে না, ভারতের সাথেও যাবে না। বাংলা থাকবে স্বাধীন!’ কিন্তু মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ সহ মুসলিম লীগের অবাঙালি নেতৃবৃন্দের বিরোধিতা ও কংগ্রেসের প্রধান মহাত্মা গান্ধীজীর অনাগ্রহের কারণে স্বাধীন অখণ্ড বাংলার স্বপ্ন অধরাই রয়ে যায়।
৬. আসামে অসমীয়ারা বাঙালিদের বিরুদ্ধে জাতিগত বিদ্বেষপূর্ণ ‘বাঙাল খেদাও আন্দোলন’ আরম্ভ করলে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বাঙালি মুসলমানদের রক্ষার জন্য সমগ্র আসাম চষে বেড়ান। সিলেট ভারত নাকি পাকিস্তানে যোগ দেবে এ নিয়ে বিতর্ক দেখা দিলে মাওলানা ভাসানী সিলেটে গিয়ে সিলেটকে পাকিস্তানের অংশ করতে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালান। গণভোটে সিলেটের পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে রায় দেন সিলেটবাসী।
ভাষা আন্দোলনের যৌক্তিকতা:–
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় যেখানে বাঙালিদের ছিলো এতো ত্যাগ-তিতিক্ষা-সংগ্রাম, সেখানে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হতেই বাঙালির উপর শুরু হয় বঞ্চনা ও শোষণ। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে সর্বহারা হওয়ার পর বাঙালি মুসলিম (সংখ্যাগরিষ্ঠ) কৃষক সম্প্রদায় ভেবেছিলেন, স্বাধীন পাকিস্তানে হয়তোবা তারা তাদের ন্যায্য অধিকার পাবেন, পাবেন সম্মান ও মর্যাদা। কিন্তু ৫৬ শতাংশ বাঙালির ভাষা কে রাষ্ট্রভাষা না করে একমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া হলো!
তমুদ্দুন মজলিশের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবুল কাশেম সম্পাদিত পুস্তিকায় প্রকাশিত ‘আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু?’ শীর্ষক আর্টিকেলে বর্ণিত রয়েছে : ( উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ যেমন ফারসির স্থলে ইংরেজিকে একমাত্র রাজভাষা করিয়া উপমহাদেশের মুসলমানদিগকে রাতারাতি অশিক্ষিত ও অনগ্রসর জাতিতে পরিণত করিয়াছিলো, ঠিক তেমনি বাংলার স্থলে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করিয়া বাঙালি কে রাতারাতি অশিক্ষিত করিবার প্রয়াস চলিতেছে।) উর্দু ছিলো অভিজাত মুসলিমদের ভাষা, গণমানুষের ভাষা নয়। উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্তের ফলে বাঙালিদেরকে কার্যত সরকারি চাকরির অনুপযুক্ত ঘোষণা করা হয়। কেননা উর্দু একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হলে বাঙালিদেরকে সরকারি চাকরি পেতে হলে অবশ্যই উর্দু ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন করতে হবে, উর্দু তে পরীক্ষা দিতে হবে এবং উর্দুতেই সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে।
শুধু তাই নয়, বাঙালি জাতিকে প্রতিযোগিতা করতে হবে খোদ উর্দুভাষীদের সাথে।
বর্ণহিন্দু জমিদার সম্প্রদায়ের হাতে নিপীড়িত বাঙালি মুসলমান স্বপ্ন দেখেছিলো তাদের অর্থনৈতিক মুক্তির। আর একটি সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে স্বাভাবিকভাবে সরকারি চাকরিই মধ্যবিত্ত শ্রেণির অর্থনৈতিক মুক্তির প্রধান অবলম্বন। কিন্তু উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার মধ্য দিয়ে রাতারাতি বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি কে সরকারি চাকরির অযোগ্যে পরিণত করা হলো।
বহু বছর যাবৎ বর্ণহিন্দু জমিদার দের কাছে অত্যাচারিত বাঙালি স্বাধীন পাকিস্তানে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনে ব্যর্থ হলো।
উর্দু ছিলো বাংলার অভিজাত শ্রেণির মুসলমানের ভাষা, মধ্যবিত্ত সাধারণ বাঙালি মুসলমানের ভাষা নয়। যেমন– ঢাকার নবাব হিসেবে পরিচিত আহসান মঞ্জিলের খাজারা পারিবারিক আলাপচারিতায় উর্দু ব্যবহার করতেন এবং বাংলা ব্যবহার বর্জন করতেন। মুসলিম জমিদারগণ উর্দু ভাষাকে পারিবারিক আলাপচারিতায় ব্যবহার করতেন ঐতিহ্য অনুসারে।
আহসান মঞ্জিলের খাজাগণের আদি নিবাস ছিলো কাশ্মীরে। তারা ব্যবসায়িক কাজে বাংলায় আসে ও বাণিজ্যে প্রচুর লাভবান হয়ে একসময় জমিদারী ক্রয় করতে থাকে। ঢাকার এই জমিদাররা ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের সময় বিপ্লবীদের কে নিজেদের পেয়াদা বাহিনীর সাহায্যে ধরে ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেয়। এরই পুরস্কার স্বরূপ ঢাকার জমিদার খাজা আব্দুল গণিকে ‘নবাব’ উপাধি দেয় ব্রিটিশ সরকার। সেই থেকে তারা ‘ঢাকার নবাব’।
নারীবাদী সাহিত্যিক রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন রংপুরের জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পরিবারও ঐতিহ্য অনুসারে উর্দু ভাষা ব্যবহার করতেন।
এছাড়া টাঙ্গাইলের করটিয়ার পন্নী জমিদারগণের পারিবারিক ভাষাও ছিলো উর্দু।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পরিবার প্রসিদ্ধ ‘সোহরাওয়ার্দী’ তরিকা প্রচারকারী প্রাচীন পীর পরিবার। তাই তাঁর পরিবারের ভাষাও উর্দু ছিলো। কিন্তু, সোহরাওয়ার্দী সাহেব নিজ উদ্যোগে নিজের আগ্রহ থেকে বাংলা ভাষা শিখতেন ও চর্চা করতেন। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রিয় ছিলো সর্বাধিক। তিনি নিজ কন্যা বেগম আখতার কেও বড় করেছিলেন বাঙালি সাংস্কৃতিক আবহে। বেগম আখতার স্বীয় উদ্যোগে রবীন্দ্র সংগীত শিখতেন, চর্চা করতেন, শাড়ি পরিধান করতেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বেই বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম দুই ভাগে বিভক্ত ছিলো — প্রতিক্রিয়াশীল ও প্রগতিশীল। বাংলায় মুসলিম লীগের ‘প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের দুর্গ’ হিসেবে পরিচিত ছিলো আহসান মঞ্জিল। প্রতিক্রিয়াশীল অংশের নেতৃত্বে ছিলেন খাজা পরিবার ও অন্যান্য মুসলিম জমিদারগণ।
প্রগতিশীল অংশে ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, ইয়ার মোহাম্মাদ খান, শামসুল হক প্রমুখ। প্রগতিশীল অংশটি প্রতিনিধিত্ব করতো বাংলার মুসলিম মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির। পরবর্তীতে এই প্রগতিশীল অংশটিই জাতীয় প্রয়োজনে স্বাধীন পাকিস্তানে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে প্রগতিশীল অংশের প্রার্থী শামসুল হক প্রতিক্রিয়াশীল অংশের প্রার্থী খুররম খান পন্নী (করটিয়ার জমিদার) কে পরাজিত করে এক বিরাট ইতিহাস সৃষ্টি করেন!
১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট কুখ্যাত ‘কলকাতার দাঙ্গা’র উস্কানি দিয়েছিলেন খাজা নাজিমউদ্দিন। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন— “ব্রিটিশ নয়, আমাদের শত্রু হিন্দুরা।” উদ্দেশ্য ছিলো– কলকাতায় হিন্দু-মুসলিমের দাঙ্গা বাঁধিয়ে প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী কে সকলের সামনে ব্যর্থ প্রমাণ করা ।
১৫ই আগস্ট ১৯৪৬ সোহরাওয়ার্দীর প্রধান ছাত্রনেতা শেখ মুজিবের নেতৃত্বে কলকাতায় ট্রাক মিছিল বের হয় যাতে স্লোগান ছিলো—’আপ আপ লীগ ফ্ল্যাগ আপ, ডাউন ডাউন ব্রিটিশ ইম্পায়ার!’
এ কে ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা পার্টিও বাংলার সাধারণ মুসলিমের প্রতিনিধিত্ব করতো। মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের ছাত্রনেতৃবৃন্দই ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি তে ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করে। সাধারণ বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভাষার বদলে প্রতিক্রিয়াশীল জমিদার শ্রেণির ভাষা উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দ্বারা পাকিস্তান রাষ্ট্র যে বাঙালি সাধারণ মুসলিমের স্বার্থকে গুরুত্ব দেয় না, তা প্রমাণ হয়ে গেলো! আর তাই তখন বাঙালি আওয়াজ তুললো রাষ্ট্রভাষা বাংলার, দাবি উত্থাপন করলো সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা কে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের !
‘৫২–এর ভাষা আন্দোলন তাই ছিলো সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমানের অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই..ন্যায্য অধিকার আদায় করার লড়াই……
তথ্যসূত্রঃ
১। ব্রিটিশ ভারতে সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়ন — প্রফেসর মোঃ মোজাম্মেল হক
২। Pakistan, The Real Picture — Rizwana Zahid Ahmed (A comprehensive history cours
লেখক: রাজিত তাহমীদ জিত
Views: 0