ডোরবেল বেঁজে উঠতেই রান্নাঘর থেকে দরজা খুলতে উঠে আসলো রিমি । ভাবলো এই দুপুরে কে আসলো অসময়ে!!! দরজা খুলেই খুশির ঝিলিক বয়ে গেলো মনের সেতুতে… ওর বড় ভাই রাকিব এসেছে । অনেকদিন ভাইয়ার সাথে আড্ডা দেয়া হয় না । আজকে ইচ্ছেমত গল্প করা যাবে ভেবে ভাইয়াকে ফ্রেশ হতে বলেই রান্নাঘরে যেয়ে ভাইয়ার প্রিয় খিচুড়ির বন্দোবস্ত করতে লাগলো আর বেডরুমে এক পলক নিজের আদরের দুলাল জামিলকে আদর দিয়ে আসলো, জামিলের বয়স মাত্র ৪ বছর। এই বয়সেই অনেক স্মার্ট আর অনেক চালাক-চতুর পিচ্চিটা । আর সব দিনের মতই ও টিভিতে প্রিয় কার্টুন দেখছে এক মনে ।
ফ্রেশ হয়েই রাকিব রিমিকে ডেকে বলল, জামাই কোথায় ?
রিমি বলল, আর কোথায়!! অফিসে কাজে ব্যাস্ত! একটু আগে ফোনে কথা হয়েছে লাঞ্চ করে নেবে একটু পরেই ।
রাকিব জিজ্ঞেস করলো, আমাদের বাবুসোনাটা কোথায়?
ও টিভিতে দেখছে কার্টুন । উফফ ভাইয়া পিচ্চিটাকে নিয়ে যন্ত্রণায় আছি!! সারাদিন পাইসে এক টিভি না হয় মোবাইলে গেমস! এই দুটোর একটা না হলে উনাকে খাওয়ানোই যায় না!! দুনিয়া উল্টায় গেলেও ওকে এই দুটোর কোনও একটা দিতে হবে! নাহলে পুরা ঘরবাড়ি মাথায় করে তুলবে চিৎকারে । কি যে করি!!
রাকিব বলল, রিমি তোকে একটা জরুরি জিনিষ বলব, তবে তার আগে তুই রান্না শেষ করে আয় ।
দুপুরের খাবার টেবিল এ বসতেই নিজের প্রিয় খিচুড়ি আর সাথে বোনের হাসিমাখা মুখ দেখে খুব ভাল লাগলো রাকিবের । ভাগ্নে জামিল যথারীতি টিভি নিয়ে বসে আছে…টিভির সামনে বসেই খেলো পিচ্চিটা ।সবার খাওয়া এবং নামাজ শেষে বোনের সাথে জরুরি কিছু কথা বলার জন্যে বসলো রাকিব ।
বল ভাইয়া কি এমন জরুরি কথা বলবা? প্রশ্নবোধক চাহুনি রিমির,
আচ্ছা একটু আগে যে তুই অভিযোগ করলি জামিল সারাদিন এইসব টিভি আর মোবাইলে পরে থাকে তুই কি এটা বুজতেছিস জিনিসটা ঠিক হচ্ছে না! এই বয়সে বাচ্চারা এরকম টিভি আসক্ত হয়ে গেলে কিন্তু ওদের ভবিষ্যৎ এ অনেক সমস্যা হবে।
হা ভাইয়া আমি কিছুটা বুঝি বেপারগুলো কিন্তু ওতো কার্টুন দেখে আর গেমস খেলে এখানে সমস্যা কোথায়? আর এগুলো দিয়েই তো ওকে ব্যস্ত রাখি নাহলে তো আমি ঘরের কাজ এই করতে পারব না!
আমি সে আগে বুঝতে পারসি রিমি, কিন্তু তুই কেন ওকে এগুলো করতে দিচ্ছিস কিন্তু আমি তোকে কিছু ইম্পরট্যান্ট জিনিষ বলছি, ব্যাপারটা মাথায় রাখ, এরপর তুই ডিসাইড কর তুই কি করবি।
হ্যাঁ বল ভাইয়া ।
যা বলছি ভালমত খেয়াল কর, যখন একটা বাচ্চার জন্ম হয় তখন তার ব্রেইনের ওজন থাকে গড়ে ৩৩৩ গ্রাম আর ২ বছর পর টা প্রায় ৩ গুন হয়ে প্রায় গড়ে ৯৯৯ গ্রাম হয় । এবং ছোটকালেই বেশিরভাগ ব্রেইন এর ডেভেলপ হয়ে যায় । এই সময়টায় বাচ্চারা যা করবে বা যেইসব জিনিসের সংস্পর্শে আসবে সেগুলোই তাদের মাঝে ঢুকে যায় এবং বাচ্চাটা বড় হয় ঐসব জিনিষ ধারন করে । তাদের ব্রেইনের গঠনেও সেরকম চিন্তাধারা বেশি হয় । আমরা মনে করি বাচ্চারা বড় হয়ে সবকিছু হয়তো বুঝে কিন্তু বাচ্চা বয়সেই ওদের বোঝার ক্ষমতা থেকে শুরু করে আরও অনেক কিছু আস্তে আস্তে ডেভেলপ হয় ।
ভাইয়া এগুলা তো জানতাম না কিছু!! অবাক হয়ে বলল রিমি…
জানলে তোর ছেলেকে সারাদিন টিভির সামনে বসায় রাখতি না! শুন টিভি তে যখন একটা কিছু দেখায় তখন খুব দ্রুত দৃশ্য পরিবর্তন হয়। অর্থাৎ এই মুহূর্তে ঘরের দৃশ্য দেখাচ্ছে তো সাথে সাথে দেখা যাচ্ছে গ্রামের দৃশ্য আবার একটু পরেই পাহাড়ের দৃশ্য দেখাচ্ছে । জিনিসটা কার্টুনেও প্রচুর হচ্ছে! এরকম দ্রুত দৃশ্য চেঞ্জ হচ্ছে বলে বাচ্চারা অভস্ত হয়ে যাচ্ছে এই জিনিষটার সাথে। কিন্তু টিভিতে যা দেখায় সেগুলো বাস্তব না! বাচ্চারা এই অবাস্তব জিনিষকেই সাধারন ধরে নিচ্ছে। কিন্তু বাস্তব জীবন এরকম না! বাস্তবে এত দ্রুত দৃশ্য চেঞ্জের কাজ সম্ভব না! এই কারনে যেসব বাচ্চা অনেক সময় ধরে টিভি দেখে ওদের কাছে বাস্তবতা বোরিং লাগে এবং তারা বাস্তব জীবন সম্পরকে হতাশ অনুভুতি পায় কারণ টিভি দেখে ওদের জীবন সম্পর্কে চাওয়া হয় একরকম আর বাস্তবে পাচ্ছে আরেকরকম । ওরা এজন্যে বাস্তব জীবনকে আপন করে নিতে পারে না বা পারলেও অনেক কষ্ট হয় ।
ভাইয়া এই ব্যাপারটা আগে তো একদমই খেয়াল করি নাই!!! আসলেই তো পাশের বাসার ছেলেটাও এরকম ছোটবেলা থেকে অভ্যস্ত হয়ে গেছে আর এখনো একটু বড় হলেও ওর আচার আচরণ এ এর প্রভাব খেলা করেছি কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে এরকমভাবে ভেবে দেখিনি তো !!
ভেবে দেখার জন্যেই তো তোকে এতকিছু বলছি । দেখ ৩ বছরের চেয়ে কম বয়সি বাচ্চাদের প্রতি ১ ঘন্টা টিভি দেখার জন্যে কোন ব্যাপারে ওদের মনোযোগ দেয়ার ক্ষমতা প্রায় ১০% করে কমে যেতে পারে ফলে ভবিষ্যতে দেখা যাবে ওরা কোন একটা ব্যাপার এ খুব একটা বেশি মনোযোগ দিচ্ছে না!! মনোযোগের অভাব ঘটছে পড়াশুনাতে বা লাইফের যেকোনো ব্যাপারেই ।
ভাইয়া এখন এর সমাধানের উপায় কি?
খুব সহজ তুই বাচ্চাদের কে সময় দে । সময় মানে এটা না যে তুই টিভি দেখছিস আর ও তোর পাশে বসে খেলছে! কোয়ালিটি টাইম দে ওকে,
কোয়ালিটি টাইম মানে ভাইয়া??
মানে এমন কিছু কর যেটাতে তোরা দুজন একসাথে করতে পারলি, মনে কর একসাথে মিলে লেগো বানালি, দুজনে মিলে রঙ করলি ইচ্ছেমত, ছোট ছোট ধাধা দিলি কিনবা ছোট ছোট মজার মজার কাজ দিলি জেগুলা করে ও আনন্দ পাবে আর তুইও একসাথে জয়েন করতে পারলি ওর সাথে, এখন তো শহরে খেলার জায়গার খুব অভাব তবুও চেষ্টা করবি যেটুকু পারবি ওকে খেলার সুযোগ করে দেয়ার । আর সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট হোল ওকে ইস্লামের শিক্ষাগুলো আস্তে আস্তে দেয়া শুরু কর, ছোটবেলা থেকে যদি তুই ওকে ইসলাম এর ব্যাপারগুলো বুঝাতে পারিস তবে ও ঠিক পথে চলতে পারবে অনেক সহজে, ও হয়তো তোকে অনেক প্রশ্ন করবে তুই সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়ার চেষ্টা করবি সুন্দর করে যেন অর আগ্রহ নষ্ট না হয়! যদি ওর আগ্রহ নষ্ট করে দিস তাইলে কিন্তু লাভ হবে না। তোকে ধৈর্য ধরতে হবে আস্তে আস্তে ওকে শেখাতে হবে তাহলে দেখবি ইনশাআল্লাহ ও একজন প্রকৃত মুসলিম হিসেবে গড়ে উঠেছে।
ভাইয়া তুমি অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বললে, আমি এগুলার কিছুই জানতাম না! আমি এখন থেকেই চেষ্টা করব তোমার কথামতো চলার । তুমি দোয়া করো ভাইয়া।
তাতো করি সবসময়, শুন আমাকে এখন উঠতে হবে একটা কাজ আছে, জাওয়ার আগে একটা কথা বলে যাই মনে রাখিস আজীবন…
“তুমি যদি একটা গল্পের শুরুটাই বদলে দিতে পারো তবে পুরো গল্পটাই বদলে যাবে”
লিখেছেন- (আশফাকুল ইসলাম তন্ময় )
Views: 9
One Comment
সংখ্যালঘু
আমাদের সমাজে দেখা যায়- সন্তানেরা খারাপ হলে একচেটিয়াভাবে তাদেরকেই দোষ দেয়া হয়- অথচ ছোটবেলায় মা-বাবারা তাদেরকে সুশিক্ষা না দেয়ার অভাবে যে এমন হচ্ছে- সেটা কেউ বুঝে না…