ভারতে কিছু সশস্ত্র দল শতবর্ষ পুরনো মসজিদ আর লাইব্রেরিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। সত্তর এর দশক থেকে মায়ানমারে ১০ লক্ষ মুসলিম জোরপূর্বক বাস্তুহারা হয়েছে এবং অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। দুইশ এরও অধিক উইঘুর শিশু চায়নায় কারাবন্দী হয়েছে শুধুমাত্র ইসলামী শিক্ষা গ্রহণের অপরাধে। এবং এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি মাসের পর মাস ফিলিস্তিনে সংঘর্ষ বেড়েই চলেছে। আপনি যখন এই কথাগুলো শুনছেন বা পড়ছেন এই পৃথিবীর বুকেই কোথাও না কোথাও মুসলিমরা নিপীড়িত হচ্ছে হাজারো মানুষের হত্যা এবং ধ্বংসলীলা ঘটেই চলেছে । বছরের পর বছর এই পাশবিকতার যেন কোন শেষই হচ্ছে না।
আপনি প্রশ্ন করতে পারেন কিন্তু ভাই আমরা মুসলিমরা না ২০০ কোটি । কেন আমরা আমাদের ভাই বোনেদের রক্ষা করতে পারছি না ? যখন পৃথিবীতে এমন কোন দেশ নেই যেটি জনসংখ্যার দিক দিয়ে মুসলিম উম্মাহ সমান।
তবে কেন আমরা এত দুর্বল ঠিক কবে থেকে আমরা নিজেদের আওয়াজকে এতটা দমিয়ে ফেলেছি ঠিক কি করে আমরা এতটা পিছিয়ে পড়লাম ?
কিছু ব্যাপার আমরা একেবারেই বুঝে উঠতে পারছি না। আজ আমরা এসব প্রশ্নের পেছনে লুকিয়ে থাকা কারণগুলো খুঁজে বের করব । এবং এই কারণগুলো থেকেই তাদের সম্ভাব্য সমাধান গুলোকে বের করে আনবো । কারণ সমস্ত সমাধান ঠিক এই কারণগুলোর ভেতরে কি আছে?
ইস্তাম্বুল বিজয় পূর্ব নাম কনস্টান্টিনোপল। মানব ইতিহাসের অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট একটি যুগের সমাপ্তি ঘটিয়ে অন্যটির সূচনা করেছিল এটি। যা ইসলামের ইতিহাসেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক মুহূর্ত বিখ্যাত অটোমেন সুলতান মেহমেদদা কনকোয়ারার যিনি মোহাম্মদ ফাতেহ নামেও পরিচিত। তিনি ভীষণ ভাবে কনস্টান্টিনেপল জয় করতে চাইতেন। যাই হোক সেটাকে জয় করার লক্ষ্য একেবারেই সহজ কিছু ছিল না। বহু জাতি ইতোমধ্যেই একাধিকবার চেষ্টা করেছে কিন্তু কেবি সফল হতে পারেনি। কনস্টান্টিনেপল এমন এক শহর যাদের ছিল দুর্বৃদ্ধ কিছু দুর্গ আর অসাধারণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এই দুর্গ জয় করতে অভূতপূর্ব কিছু প্রয়োজন যা আগে কেউ কখনো করেনি যেমনটা আগে কখনো চেষ্টাই করা হয়নি। এই জয় অর্জনে মূলত যে জ্ঞানের প্রয়োজন তা পৃথিবীর বুকে কোথাও লুকানো ছিল।
সেই বিশেষ জ্ঞানের উৎস ছিলেন এক দক্ষ কামান নির্মাতা অরবান নামক এক হাঙ্গেরিয়ান কামান শিল্পী। তিনি একাধিক ধাতুর মিশ্রণে একটি সংকর ধাতু আবিষ্কার করেন এবং তিনি বুঝতে পারলেন এই ধাতু দিয়ে তিনি ভীষণ শক্তিশালী কামান প্রস্তুত করতে পারবেন। সেই সময়টাতে অরবান জানতে পারলেন মোহাম্মদ ফাতিহ কনস্টান্টিনেপল দখল করতে যাচ্ছেন। তার পরিকল্পনা ছিল এই বিশেষ জ্ঞান বিক্রি করা। কিন্তু সুলতানের কাছে নয় তিনি প্রথমে গেলেন বাইজেন্টাইন সম্রাটের কাছে তাকে বললেন- আমি একজন দক্ষ কামান শিল্পী আমি একটি বিশেষ সংকর ধাতু আবিষ্কার করেছি; এর ফলে কামানের গোলাগুলো অনেক শক্তিশালী হবে ও অনেক দূরের লক্ষ্য ভেদ করবে। এই ধাতু আমি তোমাকে দিতে প্রস্তুত কারণ আমি শুনেছি যে অটোমানরা এই শহর দখল করতে আসছে। তুমি এটিকে তাদের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে পারবে।
বাইজেন্টাইন সম্রাট এসব শুনে ভীষণ খুশি হলেন। তিনি বললেন এই সংকট প্রস্তুতির ফর্মুলা আমি দেখতে চাই। অরবান বললেন তুমি যদি আমাকে এই পরিমাণ স্বর্ণ দাও তাহলে আমি এর কৌশল লেখা কাগজ তোমাকে দিয়ে দিতে পারি। শুনে সম্রাট তাচ্ছিলের হাসি হেসে বললেন – তো তুমি বলতে চাও তুমি আমাদের এক টুকরো কাগজ দেবে আর তার বিনিময়ে এতগুলো স্বর্ণমুদ্রা দিতে হবে ? সত্যিই তিনি তার সৈন্যদের আদেশ দিলেন এই লোকটিকে অন্ধকূপে নিক্ষেপ করো।
কিছু সময়ের মধ্যেই এই ঘটনার কথা মোহাম্মদ ফাতেহের কানে পৌঁছালো।
কিভাবে ?
কারণ কনস্টান্টিনোপলে তার কিছু গুপ্তচর ছিল। গুপ্তচরেরা তাকে জানালো সেই কামার নির্মাতার পরিণতি। সুলতান উৎসাহী হয়ে বললেন তাকে অন্ধকূপ থেকে বের করে আনতে। যা কিছু প্রয়োজন করো আর তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো ।
তার লোকেরা অরবানকে উদ্ধার করে সুলতানের কাছে নিয়ে এলেন। মোহাম্মদ ফতেহ তাকে প্রত্যাশার চাইতে দ্বিগুণ পারিশ্রমিক দিলেন এবং সেই ধাতু দিয়ে অনেকগুলো বিশাল এবং বিধ্বংসী কামান তৈরি করলেন। এরপরেই শুরু হলো কনস্ট্যান্টপোল দখলের যুদ্ধ। সেইসব ভয়ঙ্কর বিধ্বংসী অস্ত্রেই শহরের প্রতিরক্ষা দেওয়ালে বিরাট ফাটোলা এবং গর্ত তৈরি হলো। আর সবশেষে তিনি শহরটি দখল করে নিলেন।
শুধু চিন্তা করে দেখুন যে অর্জন বিগত কয়েক শতাব্দীতে সম্ভব হয়নি; কেবলমাত্র এই অস্ত্রের জোরে সেটা অবশেষে অর্জন সম্ভব হলো।
এখন ঠিক বিপরীত চিত্রটি কল্পনা করা যাক। যদি বাইজেন্টাইন সম্রাট শুরুতেই কামার নির্মাতাকে বলতেন ঠিক আছে এই স্বর্ণমুদ্রাগুলো নাও আর অস্ত্রটি প্রস্তুত করো। ফলাফল কিন্তু একেবারেই ভিন্ন হতে পারতো।
আপনি কি জ্ঞান প্রচেষ্টা সংগ্রামের মূল্য বুঝতে পারছেন ? ওই কাগজের টুকরার লেখাগুলোকে সামান্য মনে হলেও এর মূল্য বুঝলে অপর পক্ষকে জয় আর শাসন করার ক্ষমতা পেয়ে যাবেন। আপনি কি জানেন যাকে আমরা মেধা পাচার বলি সেটা নতুন কিছু নয় ।
মোহাম্মদ ফতেহ তার সময়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন মেধাবী এবং জ্ঞানী লোকদের ইস্তাম্বুলে জড়ো করতে। তিনি তাদের উপহার উপঢোকন পাঠিয়ে আমন্ত্রণ জানাতেন। উদাহরণস্বরূপ আলী খুশী এক প্রতিভাবান জ্যোতির্বিদ এবং গণিত বিশারদ। সুলতান তাকে নিজের দেশে আনতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছিলেন। তাকে আত্মীয়-পরিজনসহ আমন্ত্রণ জানান এবং প্রতি শহর পরিভ্রমণের জন্য হাজার স্বর্ন মুদ্রা প্রদান করেন।
চলুন আরেক যুগে ফিরে যাই আপনি কখনো আন্দালুসের উমাইয়াদ রাজ্যের কথা শুনেছেন। এটা এমন এক রাজ্য যা কিনা জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিক দিয়ে ছিল। সবচেয়ে উঁচুতে বিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী পিয়ার কুরি বলেন মুসলিম আন্দালুসিয়া থেকে মাত্র ৩০ টি বই উদ্ধার হয়ে আমাদের হাতে এসেছিল। সেগুলোর সাহায্যে পরমাণু পর্যন্ত দ্বিখন্ডিত করতে সক্ষম হয়েছি । বাকি বইগুলো মোগলদের আক্রমণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। পিয়ার কুরি আরো বলেন যদি পুড়ে যাওয়া ১০ লক্ষ বইয়ের অর্ধেকও বেঁচে যেত হয়তো এতদিনে আমরা মহাকাশের গ্যালাক্সি গুলোতে ঘুরে বেড়াতাম।
আপনি কখনো সিনার কথা শুনেছেন যিনি আবিসিনা নামেও পরিচিত। তাকে চিকিৎসকদের গুরু বলা হয়। তার বইগুলো ইউরোপে প্রায় ৬০০ বছর ধরে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে পড়ানো হয়েছিল। জাবির ইবনে হায়ানের দিকে লক্ষ্য করি তাকে বলা হয় রসায়নের প্রতিষ্ঠাতা। এরপর আরো আছেন আল জাহারাবি যাকে সার্জারির জনক গণ্য করা হয়। এরকম আরো অসংখ্য নাম রয়েছে যখন জ্ঞান আমাদের হাতের মুঠোয় ছিল। আমরা মুসলিম ছিলাম কর্তৃত্বে ছিলাম পথ প্রদর্শক। এমন চিত্র আমরা দেখতে পেয়েছি আন্দালুসিয়ান উমাইয়াদ রাজ্যের সময়ে। দেখেছি অটোমান সাম্রাজ্যের সূচনার সময়সহ বেশ কিছুকালে।
মনে করে দেখুন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাল্লামের সময়কাল খন্দকের যুদ্ধের সময় সালমান আল ফারসি একটি পরামর্শ দেন শুধুমাত্র কয়েকটি বাক্য। আর মুসলিমরা খন্দক খনন করতে শুরু করলেন। এই কারণেই যুদ্ধের চিত্রপট নাটকীয়ভাবে পাল্টে গেল।
এমন আরো অনেক উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে। একদিকে একজন মুসলিম বেছে নিতে পারেন একজন দক্ষ ও জ্ঞানী ব্যক্তিত্বহিসেবে গড়ে ওঠার পথ। অথবা তিনিই হতে পারেন এমন একজন যে কখনো আত্মন্নয়নের বা কিছু শেখার চেষ্টা করেনি। যে শুধু খায় পান করে ঘুমায় এবং শুধু আনন্দের জন্য বাঁচে।
যখন মুসলিমরা হয়ে ওঠেন জ্ঞানী দক্ষ এবং যোগ্য ইতিহাসের ধারায় তখন ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে শুরু করে। কারণ আমাদের ধর্মই আমাদের এসব যোগ্যতা অর্জনে উৎসাহিত করে।
আপনি কি কখনো এমন আয়াত শুনেছেন যেটা জ্ঞান অর্জন থেকে দূরে থাকতে বলে। বা এমন হাদিস যা বলে শুধু ইবাদত করো গবেষণা বা আত্ম উন্নয়নের চেষ্টা করো না। মানে বিজ্ঞানীদের তো ইসলামে কোন জাদুকর মনে করা হয় না। হয় কি ? বরঞ্চ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য ফরয।
কোরআন সবসময় আমাদের উৎসাহিত করে চিন্তায় এবং গবেষণায় যুক্ত হতে বলা হয়েছে- তারা কি চিন্তা করে না তারা কি পর্যবেক্ষণ করে না?
মুসলিমদের উন্নতি ও ধ্বংস দুটোই নির্ভর করে আল্লাহ তা’আলার এই নির্দেশ না মানার উপরে। সাধারণত আমরা যখন আল্লাহর আইনের কথা বলি তখন হারাম এবং ইবাদতের পদ্ধতিগুলোর কথা ভাবি। কিন্তু আল্লাহর আইনের দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারা রয়েছে।
প্রথমটি হলোঃ ধর্মীয় বিধান যেখানে রয়েছে কি কি জিনিস নিষিদ্ধ এবং কোনগুলোর অনুমতি রয়েছে ইবাদত হালাল হারাম এসব।
দ্বিতীয় ধরনের আইনগুলো আল্লাহতালা কর্তৃক তার সৃষ্টি এবং মহাবিশ্বের জন্য নির্ধারিত যেটা সুন্নাতুল্লাহ নামেও পরিচিত।
প্রথম ধরনের নিয়ম আমরা মেনে চলছি কিনা তার ফল এবং পরিণাম আমরা মৃত্যুর পর ভোগ করি। কিন্তু আল্লাহর দ্বিতীয় ধারার আইন মেনে না চলার ফল মানুষ এই পৃথিবীতেই ভোগ করে। আর উপকারী জ্ঞানকে তার প্রাপ্য সম্মান দেওয়া সেই আইনগুলোর মধ্যে একটি ।
তো – মুসলিম হিসেবে সে সকল মৌলিক আইনগুলো কি কি – যেগুলো মেনে না চললে আমরা আমাদের জীবনে দুর্বল হয়ে পড়ি?
মহান ইসলামী চিন্তাবিদ, বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসি তার এক বিশেষ বক্তব্যের উত্তর দিয়েছেন। আমাদের শত্রু হলো অজ্ঞতা দারিদ্রতা এবং দ্বন্দ্ব। এই তিন প্রকাশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে আমরা জিহাদে নামবো শিল্প জ্ঞান আর একতাকে অস্ত্র বানিয়ে ।
আমরা ইতোমধ্যে আলোচনা করেছি জ্ঞান এবং শিক্ষা কি না করতে পারে? মনে করে দেখুন মোহাম্মদ ফতেহ কি করেছিলেন, আর অন্য দুটির ব্যাপার? দারিদ্র আর দ্বন্দ ? বদিউজ্জামান দ্বন্দ দিয়ে কি বোঝাতে চেয়েছেন ? তিনি বলেছেন বিভেদ বিভাজনের কথা। এক্ষেত্রে একটা উপমা দেওয়া যেতে পারে। দুই বীর যখন একে অপরের সাথে লড়াই করেন, তখন একটি শিশুও তাদের হারিয়ে দিতে পারে। এর মানে হচ্ছে আমরা যখন মুসলিম হয়ে বা মুসলিম প্রধান রাষ্ট্র হয়ে ক্রমাগত একে অপরের সাথে লড়াই করছি; নিজেদের মধ্যেই দ্বন্দ্ব বা সম্পর্কে শীতলতা থাকে; আমরা যদি এক হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে না দাঁড়াই অবশ্যই আমরা পেছনে পড়ে থাকবো।
আর কে সবচেয়ে বেশি খুশি হয় যখন মুসলিমরা একে অপরের সাথে দ্বন্দে জড়ায়? অবশ্যই ইসলামের শত্রুরা । কেন ? কারণ যতক্ষণ আমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন আমাদেরকে হারানো তাদের পক্ষে ভীষণ সহজ। দেখুন একজন মুসলিম ব্যক্তি অথবা একটি মুসলিম সম্প্রদায় ভুল করতেই পারে।
কিছু জিনিস হয়তো আমাদের বিচলিত করে কিন্তু এমন কিছু যখন ঘটে তার সমাধান কি হবে? এর সমাধান কি অন্যান্য মুসলিম ব্যক্তি বা গ্রুপ থেকে নিজেদের সরিয়ে বা আলাদা করে নেব ? এর সমাধান কি তাদের সম্পর্কে নেতিবাচক ও ধ্বংসাত্মক আলোচনা করব একটি মুসলিম গ্রুপের কি অন্য একটি মুসলিম গ্রুপকে বর্জন বা আলাদা করে দেওয়া উচিত?
না!
আপনি কি জানেন এমনকি বেদুইনরাও যারা প্রাচীন আরবের মরুবাসী মানুষ তারাও এমনটা করতো না। কথিত আছে তৎকালীন দুটি বেদুইন সম্প্রদায় ছিল যারা নিজেদের একে অপরের শত্রু মনে করতো! তারা প্রায়ই যুদ্ধে জড়াতো। কিন্তু বাইরের বড় শত্রু এসে তাদের আক্রমণ করলে নিজেদের মধ্যে শান্তি ও ঐক্য এনে তারা শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তো।
অন্য কথায় বলতে গেলে আমাদের নিজেদের ভেতরকার কলহে এবং শত্রুতায় আমরা নিজেদের দুর্বল করে ফেলছি। এই সময়ে অনেক মানুষ ইসলামকে আক্রমণ করছে। মুসলিমেরা ক্রমাগত হারামের জালে জর্জরিত বিভিন্ন দেশ জড়িত এর পেছনে মিডিয়াতে ইসলাম বিরোধী পোস্ট সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষতিকর কন্টেন্ট আরো অনেক কিছু।
এখন অসংখ্য শত্রু চারপাশে অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় একতা এখন বেশি জরুরী। সেই সময়ে এই বিভাজন কতটুকু যুক্তিযুক্ত?
তো এই বৃহত্তর উদ্দেশ্যটি দেখতে না পাওয়ার অক্ষমতা; এই হুমকিগুলো সম্পর্কে উদাসীনতা; অন্যভাবে বললে শিক্ষার অভাব আমাদেরকে বিভাজনে ঠেলে দেয়। অর্থাৎ বদিউজ্জামানের বক্তব্যের প্রথম উপাদানটি আমাদেরকে দ্বিতীয়টির দিকে ইঙ্গিত দেয় দ্বন্দ্ব বিভাজন। তো তখন কি ঘটে যখন দ্বন্দ আর শিক্ষার অভাব দুটি উপাদানই একত্র হয়। তৃতীয় উপাদানটির জন্ম হয় দারিদ্রতা।
কখনো ভেবে দেখেছেন পৃথিবীর বিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলোর কয়েকটি মুসলিম মালিকানাধীন? আমরা এই প্রশ্নের খুব পরিষ্কার একটি উত্তর পাই। যখন ইসরাইলের বিরুদ্ধে বয়কট লিস্ট প্রকাশ হয়। আমাদের অর্থনৈতিক শক্তি যদি না থাকে, আমরা জোরালো আওয়াজ তুলতেও ব্যর্থ হয়ে যাই । কোন এক সময় আমি একটি চমৎকার মন্তব্য শুনেছিলাম, মধ্যপ্রাচ্যকে পর্যবেক্ষণকারী এক গবেষক বলেন আমি দেখেছি যে – যেখানেই দারিদ্রতা সর্বোচ্চ সেখানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অপরাধ প্রবণতা সমানুপাতিক হারে বাড়তে থাকে।
তো,
তিনি অপরাধ প্রবণতা দিয়ে কি বুঝিয়েছেন? হত্যা চুরি ঠকবাজি ইত্যাদি। যে দেশ যত দরিদ্র তার অপরাধ প্রবণতার হার তত বেশি। কারণ কেউই আসলে অপরাধ করার ইচ্ছা নিয়ে জন্মায় না। আপনার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হলে চুরি করার কোন প্রয়োজনই নেই, আপনার। টাকা-পয়সা এবং সম্পদ আপনার এমনিতেই আছে। মূলত তো এই সমস্যাগুলো শুরুই হয় অর্থনৈতিক কারণগুলো থেকে। আপনি সচ্ছল হলে যেকোনো সমস্যার সহজেই সমাধান করে নিতে পারবেন। যদি সঙ্গতি না থাকে বিশেষ করে ধর্মীয় জ্ঞান দুর্বল হলে স্বাভাবিকভাবেই মানুষ সহিংসতা এবং অপরাধের দিকে ঝুঁকেপড়ে। অবশ্যই এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে দারিদ্রতা থেকে জন্ম নেয় নিম্নমানের শিক্ষা; যা পরবর্তীতে নিয়ে যায় বিভাজনের দিকে।
তো অজ্ঞতা দারিদ্রতা এবং বিভাজন একটি অন্যটির সূচনা ঘটায়। আবার তাদের বিপরীতগুলো একটি অপরটির সূচনা ঘটায়। অর্থাৎ যদি একটি ইমপ্রুভ হয় বাকি দুটিরও ইমপ্রুভ হওয়া শুরু করে।
এ পর্যায়ে আমরা বুঝতে পারছি যে বদিউজ্জামানের পর্যবেক্ষণ কি আশ্চর্য রকমের নির্ভুল। কারণ ঠিক এই তিনটি জিনিসই কিন্তু আমাদের পিছিয়ে রেখেছে।
কিন্তু এই ঘটনাচক্রের পরিবর্তন ঘটানো কি সম্ভব? আমরা সবাই ইসলামের সেই গৌরবময় দিনগুলোতে ফিরে যেতে চাই; তাই না?
যখন মুসলিমরা ছিল ক্ষমতাশালী ও উন্নতির শিখরে। সেই দিনগুলোতে যখন মুসলিম শাসিত সমাজে কোন অত্যাচারের স্থান ছিল না। তারা মুসলিম হোক বা না হোক।
আপনি হয়তো প্রশ্ন করবেন এটা কি আসলেই সম্ভব?
প্রিয় ভাই ও বোনেরা – পাতা ঝরা শীতের দিনগুলোতে বসন্তের কথা ভুলে যাবেন না। মনে রাখবেন গাছের পাতা ঝরে যাওয়ার মানে এই নয় যে সেটি শিকর থেকে একেবারে মরে গেছে। এর পেছনের কারণ কেবল ঋতু পরিবর্তন বসন্ত ফিরে এলে গাছে আবার নতুন পাতা গজিয়ে ওঠে সবুজে ছেয়ে যায় আর ফুলে ফুলে ভরে ওঠে ঠিক আগের মতো।
একইভাবে মুসলিম হিসেবে যদি আমরা লড়ে যাই যথাসাধ্য পরিশ্রম করি এই শীতের শেষে অবশ্যই বসন্ত ফিরে আসবে। সমস্যা এই নয় যে প্রতিপক্ষ ভীষণ শক্তিশালী। সমস্যা হলো আমাদের অবহেলা আর যত্নের অভাব। আল্লাহর দেওয়া ধর্মকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরার বদলে আমরা এর থেকে ক্রমেই দূর থেকে আরো দূরে সরে যাচ্ছি । তাই অন্ধকার নেমে এসেছে বলে রাত ঘুরিয়ে আসিনি। বরং সূর্য ডুবে গেছে বলেই রাত নেমেছে।
ইসলাম হলো সেই সূর্য আর যারা ইসলামের শত্রু তারা হলো সেই আধার। শুধু আমাদের অতীত আর বর্তমানকে মিলিয়ে দেখুন। সময়ের সাথে ইসলামের ভালো দিকগুলো তারা আমাদের থেকে নিয়ে গেছে। আর তাদের সব খারাপটুকু আমরা নিয়ে নিয়েছি।
ইসরাইল মিয়ানমার ভারত তাদের নিজেদের প্রচেষ্টায় অত্যাচার করার মতো শক্তিশালী হয়নি। আমাদের অলসতার কারণে তারা সেই অবস্থানে পৌঁছেছে।
কারণ আমাদের ভেতর অনেকেই নিজের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নিয়েই উদাসীন। কারণ আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা ইন্টারনেটের অন্তঃসার শূন্য কন্টেন্ট দেখে নষ্ট করি। কারণ আমাদের লাইফের কোন উদ্দেশ্য নেই। নেই ইসলামের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোন চিন্তা। আমরা ইসরাইল সমর্থনকারী কোম্পানিগুলোকে বয়কট করি, রাইট ?
সেটা অবশ্যই ভালো কিন্তু আমরা নিজেদের নফসকে কেন বয়কট করতে পারি না? আমাদের জাগতিক আরাম আয়েশকেই বা কেন নয়?
শয়তান সর্বক্ষণ চেষ্টা করে যাচ্ছে আপনাকে আল্লাহর দ্বীন এবং মুসলিম উম্মার জন্য লড়াই থেকে দূরে রাখতে। বিভিন্ন পন্থায় সে আপনাকে বিভ্রান্ত করছে। সে আপনাকে অলস বানাতে চাইছে। আপনার জীবনকে লক্ষ্য আর উদ্দেশ্যহীন করে দিতে চাইছে। কোন রকমের চেষ্টার দরকার নেই গড়িমুশি করা – নানা রকম টালবাহানা অজুহাত সবকিছুই।
তো
আমরা এসব কিছুকে বর্জন করছি না কেন ?
আপনি হয়তো ভাবছেন,
মানে, আমি কেবল একজন মানুষ আমার একার চেষ্টায় কি বা পরিবর্তন আসবে ?
আপনি কি ভুলে গেছেন আল্লাহ সূরা আল ইমরানের ১৪০ নাম্বার আয়াতে কি বলেছেন ?
যদি তোমাদেরকে আঘাত স্পর্শ করে অনুরূপ আঘাত তাদেরকেও স্পর্শ করেছিল (জয়-পরাজয়ের) এ দিনগুলোকে আমি মানুষের মধ্যে আবর্তিত করে থাকি যাতে আল্লাহ মুমিনদেরকে চিনে নিতে পারেন এবং তোমাদের মধ্যে থেকে শহীদ হিসেবে গ্রহণ করেন নিশ্চয়ই আল্লাহ জালিমদেরকে ভালোবাসেন না।
এই আয়াতের মানে হলো বিজয়ের দিনের উল্টোপিঠেই পরাজয় লুকিয়ে থাকে এবং এইভাবেই যোগ্য বিশ্বাসী এবং শক্ত ঈমানের অধিকারীরা বের হয়ে আসেন।
তো আপনি যেমনটা ভাবছেন আল্লাহর সিস্টেম সেভাবে কাজ করে না। আপনি এক নিমিষেই যেকোনো কিছুতে পরিবর্তন আশা করতে পারেন না।
যদি আমরা যথেষ্ট আত্মত্যাগ ধৈর্য এবং প্রচেষ্টা দেখাই আল্লাহ আমাদের সফল করবেন। তিনি আমাদের বিজয়ী করবেন। একমাত্র আল্লাহই বিজয় দান করতে পারেন। শুধু একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী ছাড়া আমরা কেউই এর জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করছি না ।
যখন প্রতি রাতে আপনি বালিশে মাথা রাখেন আপনার বলতে পারা উচিত আলহামদুলিল্লাহ আজ আমি ইসলামের সেবায় এই কাজটি করেছি।
আপনার এই বলে দোয়া করা উচিত যে – হে আল্লাহ আমার আজকের দিনের চাইতে আগামী দিনকে আরো উত্তম করে দাও। আপনার রব কি বলেননি যে –
হে রাসূল আপনি বলুন আমার রব তোমাদের কাছ থেকে ফরিয়াদ ছাড়া আর কি বা আশা করেন
তাই আপনি প্রার্থনা করুন নিজের জিহবা দিয়ে, হৃদয় দিয়ে শরীর দিয়ে, মন দিয়ে, অর্থ দিয়ে, স্বপ্ন দিয়ে, চেষ্টা দিয়ে, আপনার যা কিছু আছে সবটুকু দিয়ে। কারণ জিহ্বা দিয়েই প্রার্থনা হয় না। প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গুলো নেওয়া আর আত্মত্যাগ করা এই সবই ফরিয়াদের অংশ।
যদি আপনি ইসলামের জন্য কোন উদ্যোগ না নেন। ইসরাইল ফিলিস্তিনে আরো একটি শিশুকে হত্যা করবে। ভারতে আরো একটি মসজিদে আগুন জ্বলবে। মিয়ানমারে আরো এক মুসলিম নিজের বাড়ি ছাড়া হবে।
যদি আপনি কোন উদ্যোগ না নেন। পূর্ব তুর্কিস্থানে আরো এক মুসলিম নারী নিজের হিজাব খুলতে বাধ্য হবে।
আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রুগুলোকে ভুলে যাবেন না। অজ্ঞতা, দারিদ্রতা আর বিভাজন।
আমরা শক্ত হাতে নিজেদের দ্বীনকে আঁকড়ে ধরবো আর এইসবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবো। মনে প্রশ্ন জাগছে কোথা থেকে শুরু করবো? কিভাবে নেব প্রথম পদক্ষেপ?
কিন্তু সত্যি বলতে আমরা ইতোমধ্যে সেটি নিয়ে ফেলেছি। কারণ প্রথম পদক্ষেপেই ছিল এই প্রশ্নগুলো তোলা। আর আপনি সেটি করে ফেলেছেন। এটি বিজয়ের পথে এক বড় অর্জন।
তারপর দ্বিতীয় ধাপ হলো একটি লক্ষ্য স্থির করা। যদি নিজের জন্য একটি লক্ষ্য স্থির না করেন। আপনি যেকোনো কাজে যতই আগ্রহী বা উৎসাহী হন না কেন -এই উৎসাহ এই অনুপ্রেরণা কেবল এক সপ্তাহ টিকবে।
আপনার কি কোন প্রিয় টপিক আছে? তাহলে তাতে সেরা হওয়ার চেষ্টা করুন চেষ্টা করুন! সে বিষয়ে একজন মুসলিমের আইডল হয়ে উঠতে।
আপনার কি কোন বিষয়ে প্রতিভা আছে? চেষ্টা করুন সেটাকে ইসলামের পথে ব্যবহার করতে।
আপনার কি সন্তান আছে? তাদের ইসলামকে ভালোবাসতে শেখান। দ্বীনের শিক্ষা দিন।
কোন অমুসলিম বন্ধু সহকর্মী সহপাঠী বা প্রতিবেশী আছেন অথবা এমন কোন মুসলিম আশেপাশে আছে যারা দ্বীনের চর্চা করে না? নিজের দ্বীনকে সর্বোত্তম উপায়ে শিখুন চর্চা করুন। আপনার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, আপনার ব্যক্তিত্বের ধরণ, আপনার সমগ্র জীবন যেন বাইরে ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করে। যেমন ইসলামকে আরো ভালোভাবে শেখাটা যেন আপনার লক্ষ্য হয়।
আপনি যদি আপনার ইসলামিক জ্ঞানকে খুব অল্প সময়ে সমৃদ্ধ করতে চান? নিয়মিত প্রতিদিন সহজ সরল অনুবাদ সহ আল কুরআন পড়তে পারেন । এক কথায় আপনি যেই হোন না কেন অজ্ঞতা, বিভাজন আর দারিদ্রতা এগুলোকে প্রতিরোধ করুন। আর যখন সময় হবে ইসলামের মূল হিরোদের যারা ইতিহাসের পথ পরিবর্তন করবে, তাদের উঠে আসতে দিন। তাদের পেছনে এক বিশাল জমায়েত জড়ো হতে দিন। যারা ইসলামকে ভালোবাসে তাকে রক্ষা করে এবং যারা নেককারদের মধ্যে অন্যতম।
এই লেখাটি একটি ছোট গল্প দিয়ে শেষ করা যাক। আজকের সব কথার সারাংশ এই গল্পে আছে। গল্পটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম চলে আসছে ।
বহু বছর আগের কথা একজন কাঠমিস্ত্রী ছিলেন যিনি ভীষণ সুন্দর মিম্বর তৈরি করতেন। তার বানানো মিম্বরের সৌন্দর্য এতই খ্যাতি লাভ করে যে সমগ্র অঞ্চলে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। আর তার তৈরি সেই শিল্প এতই চমৎকার ছিল যে অনেক মানুষই সেটি কেনার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। কিন্তু সেই কাঠমিস্ত্রী সেসব বিক্রি করতে অসম্মতি জানিয়ে বলল এই মিম্বর আমি মসজিদ আল আকসার জন্য বানিয়েছি। কিন্তু সেই সময়ে জেরুজালেম ছিল ক্রুসেডারদের অধীনে আর তারা ছিল ভীষণ শক্তিশালী । তার এই উত্তর শুনে লোকেরা বলল তুমি স্বপ্ন দেখছো। এটা তুমি মসজিদ আল আকসায় কি করে রাখবে যখন জেরুজালেমী ক্রুসেডারদের নিয়ন্ত্রণে? সেই কাঠমিস্ত্রী বললেন আমি একজন কাঠের মিস্ত্রী। এই মিম্বর বানানো ছাড়া আমি কি বা করতে পারি? এটাই আমার দায়িত্ব। আর যখন সময় হবে, একজন নেতা আসবেন এবং জেরুজালেম জয় করবেন আর সেটি তার দায়িত্ব। শ্রোতাদের মধ্যে ছিল একটি শিশু যে সেই কাঠমিস্ত্রীর বলা প্রতিটা কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল । তার বলা প্রতিটি কথা সেই ঈমানদীপ্ত হৃদয়ে গেঁথে গেল। বহু বছর পর সেই শিশুটি বড় হলো, একটি সৈন্যদল তৈরি করে জয় করল। আর মসজিদ আল আকসায় সে মিম্বরটি স্থাপন করল। ইতিহাসের পাতায় তিনি সালাউদ্দিন আইয়ুবী নামে পরিচিত …………………………।
Views: 55