“মোগল-বিজাপুরের মধ্যে চুক্তি হওয়ার পরে বিজাপুর শিবাজীর প্রতি সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে সমর্থ হয়। এদিকে শাহজি পুত্র শিবাজী উত্তরোত্তর ব্যপক লুটতরাজে লিপ্ত হন। শাহজিকে তার পুত্রের এহেন ধ্বংসাত্মক কাজ বন্ধ করার আদেশ দিলে তিনি তার অপারগতার কথা জানান এবং বলেন যে শিবাজী তাহার শাসনের সম্পুর্ণ বাইরে। এমতাবস্থায় সম্রাট শাহজি পুত্র শিবাজীর বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হন। আফজল খান নামক একজন দক্ষ, চৌকস ও বিশ্বস্ত সেনাপতিকে শিবাজীর বিরুদ্ধে প্রেরণ করা হয়। সেনাপতি আফজল খান মহারাষ্ট্রে প্রবেশ করিয়া সদুপদেশের মাধ্যমে শিবাজী কে সৎপথে ফিরানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেন। কুচক্রী শাহজি পুত্র শিবাজী, সেনাপতি আফজল খানের সরলতা-সততার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করিলেন এবং নিরস্ত্র-নিঃসঙ্গ অবস্থায় দুজনে মিলিত হইয়া শাহজি পুত্র শিবাজী চুক্তির শর্ত সমূহ আলাপ আলোচনার প্রস্তাব করিলেন। সেনাপতি আফজল খান এ প্রস্তাব বিনা দ্বিধায় গ্রহণ করেন। এবং নির্ধারিত সময়ে ও স্থানে নিরস্ত্র ও নিঃসঙ্গ অবস্থায় শাহজি পুত্র শিবাজীর সঙ্গে মিলিত হন। কিন্তু শাহজি পুত্র শিবাজী পূর্ব হইতে আফজল খানকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেন।
শাহজি পুত্র শিবাজী আফজাল খানকে ব্যাঘ্রনখ দ্বারা আকষ্মিক আক্রমণ করেন এবং ধরাশয়ী করেন। আহত অবস্থায় আফজল খান কোনক্রমে পলাইয়া শিবিরে আশ্রয় নেন। মুসলিম বাহিনী নিজেদের সেনাপতির এমন করুণ অবস্থা দেখে কিংকর্তব্যবিমুড় হইয়া পড়েন। এই সুযোগে শিবাজীর সৈন্যবাহিনী মুসলিম বাহিনীকে হঠাত আক্রমণ করিয়া পর্যদুস্ত করে এবং পালকির ভিতর অবস্থানরত আফজল খানের শিরচ্ছেদ করে।
আফজল খান এর হত্যাকান্ড সম্পর্কে বিপরীতমুখী পরষ্পর বিরোধি দুইটি অভিমত পাওয়া যায়। হিন্দুত্ববাদী-মারাঠা ঐতিহাসিকদের মতে আফজল খান ষড়যন্ত্র করিয়া শিবাজী কে হত্যা চেষ্টা করেন কিন্তু শিবাজীর সঙ্গে না পারিয়া নিজেই নিহত হন। এ বিষয়ে মারাঠা উপকরণসমূহের এবং বিশেষ করিয়া উগ্র হিন্দুত্ববাদী-জাতীয়তাবাদী মারাঠা ঐতিহাসিকদের বিবরণ কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সমসাময়িক ঐতিহাসিক খাফি খান স্পষ্ট ও সরাসসরি ভাষায় বলেছেন যে শাহজি পুত্র শিবাজীই ষড়যন্ত্র ও পূর্ব পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রের সাহায্যে আফজল খানকে নির্মমভাবে হত্যা করেন। গ্র্যান্ট ডাফ প্রমুখ ইউরোপীয় সকল ঐতিহাসিকেরা খাফি খানের এই উক্তি সমর্থন করেন।
আফজল খানের মতো প্রাজ্ঞ, চৌকস সুদক্ষ, সুযোগ্য, সেনাপতির পক্ষে শাহজি পুত্র শিবাজীর মত কাপুরুষের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার কোন প্রয়োজন ছিল না।
পক্ষান্তরে শিবাজী প্রথম থেকেই হামেশা লুঠতরাজ এবং বিশ্বাসঘাতকতা দ্বারা স্বীয় উন্নতির পথ উন্মুক্ত করেন। সুতরাং ইতিহাসের কষ্টিপাথরে যাচাই-বাছাই করলে শাহজি পুত্র শিবাজীর পক্ষে ঐতিহাসিকদের যুক্তি ধোপে টিকেনা।।”
আফজল খানের হত্যা
সূত্রঃ ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন, ড. আব্দুল করিম স্যার।
পৃষ্টা নম্বরঃ ৩৪২
১০ নভেম্বর ১৬৫৯ খ্রীষ্টাব্দ।
বিজাপুরের সুলতান আদিল শাহের সেনাপতি নিরস্ত্র আফজল খাঁ-কে ধোকা দিয়ে কোলাকুলি করা অবস্থায় বিশ্বাসঘাতক শাহজি পুত্র শিবাজী বাঘনখের আঘাতে হত্যা করেন ।
একসময় হিন্দুরা কেউই এটা অস্বীকার করতো না যে, শাহজি পুত্র শিবাজী’ বিশ্বাসঘাতকতা করে, প্রতারণা করে সেনাপতি আফজল খাঁ’কে হত্যা করেছিল। বরঞ্চ এটা নিয়ে তারা খুব অহংকার করতো।
“১৮৮৫-এ সরকারি গণপতি পূজার প্রবর্তক ‘শিবাজী উৎসব’ নামে বাল গঙ্গাধর টিলক এক নতুন পূজা প্রবর্তন করেন । শিবাজী উৎসব উদ্বোধনে শিবাজী যেভাবে চাতুর্যের সঙ্গে আফজল খাঁকে হত্যা করেছিলেন তার গুণগান করে বলা হয় যে শত্রুপক্ষের কাউকে হত্যার জন্যে যে-কোনও ছলনা, যে কোনও বিশ্বাসঘাতকতাই ধর্মসঙ্গত । আফজল খাঁ-ও যে শিবাজীকে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন বা হত্যার কথা ভেবেছিলেন এমন কোনও গাল-গল্প ১৮৯৫-র আগে প্রচলিত ছিল না।”
সূত্র: মৌলবাদ: এক নতুন সংজ্ঞা- সুরজিৎ দাশগুপ্ত , পৃষ্ঠা-৬৪,
সমসাময়িক বিদেশি পর্যটক ও ইতিহাসবিদ, নিকোলাও মানুচি থেকে জেনে আসি বিস্তারিত। শাহজি পুত্র শিবাজীর বিরুদ্ধে আফজল খান নামে একজন বিখ্যাত সেনাপতিকে পাঠান। সেনাপতি আফজল খান, শাহজি পুত্র শিবাজী এতটাই অবিচলভাবে অনুসরণ করেছিল যে শাহজি পুত্র শিবাজী পালিয়ে পাহাড়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল।
শাহজি পুত্র শিবাজী প্রতিরোধের জন্য নিজেকে এতটা দুর্বল ও শক্তিহীন দেখে, সে একটি চক্রান্তের পরিকল্পণা ও ষড়যন্ত্রে করে। সে মোঘল সেনাপতি আফজাল খানকে একটি চিঠি লিখেছিলেন, যেখানে তিনি নানান অজুহাত দেখিয়েছিলেন। এবং সে নিজেকে একজন অপরাধী এবং দোষী বলে স্বীকার করে এবং আফজল খানকে তার জন্য স্ম্রাটের নিকট সুপারিশ করতে বলে। যাতে শিবাজি সম্রাটের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেবে।
সৎ, সহজ ও সরল আফজাল খান উত্তর দিয়েছিলেন যে, তিনি বিনা দ্বিধায় তার কাছে আসতে পারেন। আফজাল খান সম্রাটের কাছ থেকে তার (শিবাজির) ক্ষমা পাবেন এবং সর্বদা তার (শিবাজির) রক্ষক হবেন। কিন্তু সম্রাটের কাছ থেকে নতুন আদেশের প্রাপ্তি এড়াতে তাকে বিলম্ব না করে হাজির হতে হবে। যুদ্ধের বিভীষিকা শুরু করার অনুমতি দেওয়ার চেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ চুক্তিতে আসা নিজের জন্য এবং তার (শিবাজির) লোকদের জন্য ভাল হবে।
শাহজি পুত্র শিবাজী, আফজাল খানের সামনে উপস্থিত হতে সম্মত হয়েছিল, কিন্তু তাকে শর্ত দিয়ে কেবল পাঁচজন লোক নিয়ে ক্যাম্প থেকে দূরত্বে একটি জায়গায় আসার জন্য অনুরোধ করেছিল। শাহজি পুত্র শিবাজী অনুরোধ করেন বৈঠকের জন্য পাঁচজনের বেশি লোক যেন আফজাল খান না আনে। কারণ, সে (শিবাজি) আফজল খানের পায়ে পড়ে এবং তার করুণার উপর নিজেকে নিক্ষেপ করবে।
শাহজি পুত্র শিবাজী নিজেকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে চান জেনে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে আফজাল খান তার প্রস্তাব গ্রহণ করেন। শিবির থেকে কিছু দূরত্বে তিনি শাহজি পুত্র শিবাজীর অভ্যর্থনার জন্য কার্পেট সহ একটি দুর্দান্ত তাঁবু তৈরি করেছিলেন।
ইতিমধ্যে শাহজি পুত্র শিবাজী তাঁর ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য তাঁর সেনাবাহিনীকে এমনভাবে তৈরী করেছিলেন যে শাহজি পুত্র শিবাজী যখন সংকেত দিবেন, তখন সমস্ত সৈন্য তাদের ঘোড়ায় চড়ে সরাসরি রাজকীয় শিবিরে ছুটে যেতে পারে। শাহজি পুত্র শিবাজী একটি ছোট এবং অত্যন্ত তীক্ষ্ণ ল্যান্সেট প্রস্তুত করেছিলেন, যার শীর্ষে একটি প্রক্ষিপ্ত পাথরের সাথে একটি আংটির আকারে তৈরি হয়েছিল। আংটির মধ্যে একটি আঙুল ঠেলে ল্যান্সেটটি (বাঘনখ) হাতের আড়ালে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। শাহজি পুত্র শিবাজীর পাঁচজন সঙ্গী আদেশ পেয়েছিলেন যে শাহজি পুত্র শিবাজী যখন জেনারেলকে আলিঙ্গন করবেন, তখন তারা নীরবে তাদের তলোয়ারগুলি দখল করবে এবং প্রত্যেকে একজন করে নির্দিষ্ট শত্রুর উপর ঝাপিয়ে পড়বে। তাদের নেতা শাহজি পুত্র শিবাজী এর সাথের পাঁচজনই তাদের পোশাকের নিচে ডাকের কোট পরেছিলেন। কিন্তু এই সতর্কতা আফজাল খান এবং তার পাঁচজন দেহরক্ষী অবলম্বন করেননি, বা তাদের উপর ষড়যন্ত্র-বিশ্বাসঘাতকতা চালানোর বিষয়ে তারা সন্দেহও করেননি।
আফজাল খান দুই বাহিনীর মাঝখানে তার তাঁবুতে, শিবাজির আগমনের জন্য প্রচণ্ড উদ্বেগের সাথে অপেক্ষা করছিলেন। অতঃপর শিবাজি তার পাঁচ জন লোক নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে হাজির হলেন। তাঁবু থেকে কিছু দূরে ঘোড়া থেকে নামে । শিবাজি বারবার প্রণাম করে সামনের দিকে আগাতে লাগলেন, এমন ভাব, যেন তিনি একটি ভাল অভ্যর্থনা প্রার্থনা করছেন এবং শঙ্কিত অবস্থায় আছেন। আফজাল খান তাকে হাত দিয়ে ইশারা করলেন আর বুঝালেন তিনি যেন নির্ভয়ে কাছে যেতে পারেন; এবং শিবাজি কাছাকাছি আসার সাথে সাথে আফজাল খান তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। শিবাজির হাত বাঘনখসহ নীচে নেমে আসে, আফজাল খানের মত একজন লম্বা এবং অত্যন্ত শক্তিশী মানুষকে ষড়যন্ত্রে পরাভুত করে । তারপর দ্রুত এবং জোর করে সে আফজাল খানের পেটের বাম থেকে ডান দিকে ঢুকিয়ে দেয়, যাতে নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যায়। বাকি পাঁচজন তাদের তরবারি ধরে আফজাল খানের অন্যান্য সঙ্গীদের টুকরো টুকরো করে ফেলে।
এটি শিবাজির পরিকল্পনামাপিক নির্ধারিত সংকেতে করা হয়েছিল,ফলে শিবজির সৈন্যরা আফজাল খানের সেনাবাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়ে এবং সবাইকে অতর্কিত হামলায় হত্যা করে।’
সূত্রঃ
STORIA DO MOGOR
OR MOGUL INDIA 1653 — 1708,Vol-2, P-27-28
By- NICCOLAO MANUCCI
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ কর্মকতা ও ইতিহাসবিদ গ্রান্ট ডাফ তার তিনখন্ডে লিখিত A History of the Mahrattas (1826) বইতে উল্লেখ করেন, এটা স্পষ্ট যে,শিবাজি বিশ্বাসঘাতকা করে গোপনে বহন করা অস্ত্র দিয়ে আফজল খানকে হত্যা করেন।
তিনি বলেন, ‘Afzal Khan is killed by Shivaji at a personal meeting. It is clear that Shivaji had made preparations for killing him carried two hidden weapons and was wearing mail.’
(A History of the Mahrattas (1826),James Grant Duff)
সেই বিশ্বাসঘাতক শিবাজীর প্রশংসায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর শিবাজী উৎসব কবিতায় বলেছিলেন:
মারাঠির সাথে আজি, হে বাঙালি, এক কন্ঠে বলো
‘জয়তু শিবাজি’।
মারাঠির সাথে আজি, হে বাঙালি, এক সঙ্গে চলো
মহোৎসবে সাজি।
আজি এক সভাতলে ভারতের পশ্চিম-পুরব
দক্ষিণে ও বামে
একত্রে করুক ভোগ একসাথে একটি গৌরব
এক পুণ্য নামে।।
Views: 1